
পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ বছরে পশ্চিমা দুনিয়ার যেখানেই গেছেন, সেখানেই প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে বিএনপি-জামায়াত। কালো পতাকা প্রদর্শনসহ নানাভাবে তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছে দল দু’টির নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে নিউইয়র্ক ও লন্ডনে। ৩৬ জুলাই খ্যাত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সব পাল্টে দিয়েছে! হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ভারতে। তার নেতাকর্মীরা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতার সমর্থনে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার প্রতি এখনো সমর্থন রয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সেই সরকারের নির্বাহী আদেশে বিচার কার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। ফলে দেশে তারা এখনো এলোমেলো। অবশ্য বিদেশে তারা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সক্রিয়। আওয়ামী লীগের প্রবাসী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিদেশে আশ্রয় নেয়া দলটির পলাতক নেতাকর্মীরাও যে যার মতো করে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করছেন। তারা সরকারের উপদেষ্টাদের বিদেশ সফরে প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন। ঠিক যেমনটি এত বছর ধরে করে আসছিল বিএনপি-জামায়াত। তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশে অভিনব সব কৌশল নিচ্ছে লীগ সমর্থক এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল গোষ্ঠী। জাতিসংঘের ৮০তম অধিবেশনে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত রাতেই তিনি সফরসঙ্গীদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।
এবারের সফরের বিশেষত্ব হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার টিমে সরকারের বাইরে ৩টি রাজনৈতিক দলের ৬ জন প্রতিনিধি সরকারি খরচে যুক্ত হয়েছেন। বর্ণাঢ্য আয়োজনে তাদের বরণের প্রস্তুতি নিয়েছে সফরসঙ্গী নেতাদের প্রবাসী সমর্থকরা। তবে তাদের প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে নিউ ইয়র্ক আওয়ামী লীগ। সেই ঘোষণায় বিচলিত সরকারের তরফে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সফরসঙ্গীদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন- বাস্তবে ড. ইউনূসকে প্রতিহত করতে পারবে না আওয়ামী লীগ। কারণ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যাচ্ছেন তিনি। কেবল বাংলাদেশ নয়, ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধির পদভারে আগামী সপ্তাহটা মুখরিত থাকবে বিশ্বের রাজধানী খ্যাত সিটি ম্যানহাটন। সেখানে বাংলাদেশসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের সংক্ষুব্ধ মানুষদের নিজ নিজ সরকারের প্রতিনিধির প্রতি ক্ষোভ, বিক্ষোভ বা স্রেফ ঘৃণা প্রদর্শনেরও সুযোগ থাকবে। তবে তা যেন শান্তিপূর্ণ হয় সেটি নিশ্চিত করবে নিউ ইয়র্ক পুুলিশ তথা মার্কিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ওয়াকিবহাল সূত্র বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংক্ষুব্ধ জনগণ নিজে থেকে তাদের প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করেন। কিন্তু বাংলাদেশসহ কিছু দেশের প্রতিবাদকারীরা অহেতুক পরিবেশটা উত্তপ্ত করে ফেলেন। তাদের মুখের চেয়ে হস্ত আগে চলে। দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিবাদ বা কাইজ্যা বিদেশের মাটিতেও টেনে নিয়ে যান। সহিংস সেই আচরণ ঠেকাতে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। ফলশ্রুতিতে ঘটনা থামলেও তা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে দেশের ভাবমূর্তিতে দীর্ঘ মেয়াদে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
এবারে কাইজ্যার আশঙ্কা বেশি কেন? গত বছর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন জাতিসংঘে যান তখন আওয়ামী লীগ ছিল বিপর্যন্ত। সর্বাত্মক প্রতিরোধ তথা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়া আওয়ামী লীগের প্রবাসী নেতাকর্মীরা ছিল দিকভ্রান্ত-নির্দেশনাহীন। তাছাড়া আন্দোলন দমনে আওয়ামী সরকারের তরফে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ তথা গণহত্যার অভিযোগে দলটির নেতাকর্মীরা সাধারণের তোপের মুখে পড়ার আশঙ্কায় ছিল। কিন্তু এবার তারা আগের চেয়ে সংগঠিত এবং প্রতিরোধের নির্দেশনাপ্রাপ্ত। স্থানীয় সূত্রের দাবি শুরুতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মাঠ ছিল তাদের দখলে এক তরফাভাবে। কিন্তু সরকার প্রধানের সফরসঙ্গী হিসেবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, এনসিপি’র সদস্য সচিব আখতার হোসেনের নাম ঘোষণার পর পরিস্থিতি খানিকটা জটিল হয়েছে। গতকাল জামায়াত এবং এনসিপি’র আরও দুই নেতার নাম প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীর তালিকায় যুক্ত হয়েছে। তারা হলেন- এনসিপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারা, ও জামায়াতের সাবেক আমীর মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ড. নাকিবুর রহমান তারেক। নাকিবুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছেন। তিনি সেখান থেকে প্রধান উপদেষ্টার বহরে যুক্ত হবেন।
প্রধান উপদেষ্টা ও নেতাদের সফর ঘিরে বিএনপি, জামায়াত এনসিপি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ফলে এবারে বহুপক্ষীয় কাইজ্যা হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ নিজেদের আমলের ঘটনাগুলো আড়াল করে এবার ফলাও করে ড. ইউনূসের শাসনামলে দেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে ইত্যাদি প্রচারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত এবং এনসিপি ‘শান্তি সমাবেশ’ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে থাকবেন ইউনূস এবং তার সফরসঙ্গীরা: স্থানীয় সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, নিউ ইয়র্কে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে থাকবেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সফরসঙ্গীরা। তাদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নোট ভারবাল পাঠানো হয়েছে। তার সফরকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা জোরদারের জন্য নিউ ইয়র্ক পুলিশ, মেয়র অফিস এবং ফরেন সার্ভিসের কাছে বাড়তি সহায়তাও চেয়েছে বাংলাদেশ কনস্যুলেট। চিঠিতে নোবেলবিজয়ী ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। স্থানীয়রা জানান, প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানাতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা বিমানবন্দর, হোটেল এবং জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে গণজমায়েতের ঘোষণা দিয়েছেন। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও সেই সব স্থানের কাছাকাছি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ব্যাপারে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মোহাম্মাদ মোজাম্মেল হক মানবজমিনকে রোববার সন্ধ্যায় বলেন, আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে আওয়ামী লীগের তরফে প্রধান উপদেষ্টার আগমনকে কেন্দ্র করে বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হবে। এ কারণে আমরা স্থানীয় প্রশাসন, নিউ ইয়র্ক পুলিশ, মেয়র অফিসের কাছে বাড়তি নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি দিয়েছি। একইভাবে নিউ ইয়র্কের ফরেন সার্ভিসকে বিষয়টি অবগত করেছি। আশা করি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সহায়তা করবেন। কনসাল জেনারেল বলেন- প্রধান উপদেষ্টার সফর ঘিরে যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। উল্লেখ্য, ২২শে সেপ্টেম্বর মুহাম্মদ ইউনূস নিউ ইয়র্কে পৌঁছাবেন এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। তার ভাষণে জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সংস্কার, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় এবং সাবেক স্বৈরাচারী শাসন-পরবর্তী বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি তার ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু, অর্থায়ন, এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ার ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয় স্থান পেতে পারে। তার ভাষণে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করা হবে বলে জানানো হয়েছে। ভাষণ দেয়া ছাড়াও সাইড লাইনে উচ্চপর্যায়ের কিছু বৈঠকে অংশ নেবেন ড. ইউনূস। তাছাড়া প্রবাসীদের একটি অনুষ্ঠানেও অংশ নিবেন।