
দুর্গম পাহাড়ি পরিবেশে পড়ালেখা আর নানা প্রতিকূল পথ মাড়িয়ে ‘খেয়াং সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া মে থুই চিং খেয়াং লড়ছেন নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হল সংসদ নির্বাচনে নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল থেকে ‘হৃদ্যতার বন্ধন’ প্যানেলের এজিএস প্রার্থী হয়েছেন তিনি।
ফয়জুন্নেসা হলের ১৩ আদিবাসী ও বাঙালী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক শিক্ষার্থী নিয়ে ১৪ জনের একটি প্যানেল দেওয়া হয়েছে হল সংসদ নির্বাচনে, যেটির নাম ‘হৃদ্যতার বন্ধন’।
প্যানেলের ভিপি পদে পারমিতা চাকমা ও জিএস সিংঞোইউ মারমা ও এজিএস পদে মে থুই চিং খেয়াংয়ের নেতৃত্বে এ প্যানেলে রয়েছে ছয়টি আদিবাসী সম্প্রদায় চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরা, খেয়াং, তঞ্চংগ্যা এবং বাঙালী বড়ুয়া সম্প্রদায়ের এক ছাত্রী।
প্যানেল সদস্যদের দাবি, তাদের এজিএস প্রার্থী মে থুই চিং খেয়াং প্রথম শিক্ষার্থী, যিনি খেয়াং সম্প্রদায় থেকে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছেন।
মে থুই চিং খেয়াং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। তার বাড়ি বান্দরবান সদরের উহালং ইউনিয়নে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন, যাত্রা আর সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন মে থুই চিং খেয়াং।
তিনি বলেন, “(খেয়াং সম্প্রদায়ের) অনেকেই চেষ্টা করেছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হয় নাই। ২০২১ সালের শেষের দিকে আমার ভর্তি হল। অনেকেই তখন এটা বলেছে যে, আমি ভাগ্যের জোরে সুযোগ পেয়েছি।
“বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসার লড়াইটা সহজ ছিল না। আমি যখন প্রথম এখানে পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করলাম, তখন অনেকে বলেছে- তোমার আগে অনেকেই তো চেষ্টা করেছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অনেক কঠিন। এখানে হবে না তোমার। আমিও এতে একটু ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু হাল ছাড়িনি। বিশ্বাস ছিল যে, আমি পারব। আমার প্রস্তুতিও ভালো ছিল। পরিবারকে জানালাম, তারা সাপোর্ট দিল। আমি পরীক্ষাটা দিলাম।”
মে থুই বলেন, “আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পেরেছি। অন্যদেরকেও একইভাবে অনুপ্রাণিত করব এখানে আসার জন্য। এজন্য সম্প্রতি একটি লাইব্রেরি চালু করেছি। ‘চিন্তন গণগ্রন্থাগার’। আমাদের গ্রামের কুহালং পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিলে শুরু করেছি। আমার লক্ষ্য আমি এসেছি, আশেপাশের ছেলেমেয়েদেরও নিয়ে আসব।
“তাদেরও অধিকার আছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। মোটিভেশনের অভাবে বা কোনো ভয়ে হয়ত আসতে পারছে না। আমার লক্ষ্য ওদের স্বপ্ন দেখানো। যেন ওরাও পারে। আমি যেহেতু পারছি, ওরাও পারবে।”
সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী দূরদূরান্ত থেকে আসে। নিজেকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। কিন্তু আমাদের হলে দেখা যাচ্ছে, সেই আদিম যুগের মতই আমরা পড়ালেখা করছি।
“আমাদের নেটওয়ার্কের সুবিধা নাই। কম্পিউটার সুবিধা নাই। কিচেনের অবস্থা খুবই খারাপ। আপনারা গেলেই দেখতে পারবেন, কী রকম নোংরা পরিবেশে আমরা ওখানে রান্নাবান্না করে খাচ্ছি। লাইব্রেরিতে বই নেই। আমরা অ্যাকাডেমিকেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।”
ফয়জুন্নেসা হলের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের হল যেহেতু ভেতরের দিকে, রাতে ছাত্রীরা বের হতে ভয় পায়। রাত-বিরাতে ফোনের রিচার্জ বা স্যানিটারি ন্যাপকিনের জন্য বা কোনো প্রয়োজনে অন্য হলে যেতে হয়। আমাদের জন্য নাকি কোনো বরাদ্দই আসেনি এখনো।
“আমাদের হলের শিক্ষার্থীদের জন্য কী কোন বরাদ্দ রাখা যেত না? প্রত্যেক শিক্ষার্থী যেন অধিকার পেয়ে শান্তিতে সুস্থ পরিবেশে থেকে পড়ালেখা করতে পারে।”
খেয়াং সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ‘শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু করে যাওয়ার বাসনা’ থেকে হল সংসদে প্রার্থী হওয়ার কথা বলেন মে থুই।