
ঘটনা ঘটেছে একভাবে, লেখা হয়েছে অন্যভাবে। ঘটেছে রাত তিনটায়, এজাহারে লেখা হয়েছে সেটা ভোর ছয়টায়। যে হোটেলে আসামি ছিলেন, সেই হোটেলে কিভাবে তিনি সিট বুকিং নিয়েছিলেন, সেটারও কোনো তথ্য নেই। এমন অন্তত এক ডজন ভুল ধরা পড়েছে মামলার এজাহারে। যে ভুলের দরুন মামলার আসামি অনায়াসে পেয়ে যাবেন জামিন, খালাস পাবেন রায়ে।
এজাহার দেখে সংশয়, সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খোদ মাদকের মহাপরিচালক হাসান মারুফ। বলেছেন, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার এজাহারে ভুল লেখা হয়েছে, যেভাবে তদন্তের নামে আইওয়াশ করা হয়েছে, তাতে আসামিই বেনিফিট পাবেন। শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা, আসামিকে কারাগারেই রাখা যাবে না। সহসাই জামিন পেয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তিনি বলেন, এ ধরনের মামলার তদন্তভার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরেরই করা উচিত ছিল। কারণ সম্প্রতি এর আগে সাড়ে ৮ কেজি কোকেন উদ্ধারের মামলাও মাদক বিভাগ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তদন্ত করে সব আসামি ধরেছে। কিন্তু সর্বশেষ গায়েনার নারীর কাছ থেকে উদ্ধার করা কোকেনের মামলা নিয়ে সর্বনাশ করা হয়েছে।
জানা গেছে, এ মামলার এজাহারের অনেক ভুল-ত্রুটি রয়েছে। যেমন- জব্দ তালিকা প্রস্তুতকরণে বাজেয়াপ্তযোগ্য বস্তু আটক, ব্যবস্থাপনা ও নিষ্পত্তিকরণ বিধিমালা ২০২২ অনুসরণ করা হয়নি। জব্দ তালিকায় মাদকদ্রব্য জব্দের সময় বর্ণিত সময় ছিল রাত ৩টা কিন্তু এজাহারে সেই সময় উল্লেখ করা হয়েছে ভোর ৬টায়। সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের বিষয়. মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্র্রণ আইন ২০১৮ অনুসারে জব্দ তালিকায় কর্মকর্তার নাম-পদবি ও স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক থাকলেও সেটা অনুসরণ করা হয়নি। এজাহারে অভিযানের সময় শুরু ও শেষ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ নেই। গ্রেপ্তারকৃত আসামির আমন্ত্রণ পত্রও অন অ্যারাইভাল ভিসা জব্দ করা হয়নি। মাদক আইন অনুযায়ী স্থির চিত্র ও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়নি।
এ ছাড়া কোনো কন্টেইনার থেকে কি পরিমাণ কোকেন বা মাদক উদ্ধার করা হয়েছে এজাহারে তা লিপিবদ্ধ করা হয়নি। এমন আসামির মোবাইল ফোন ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ ঘটনায় সম্পৃক্ত দেশি-বিদেশি নাগরিকদের চিহ্নিত করা হয়নি। সত্যিকার অর্থে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তে আসামিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েও কোনো একটি তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ নিয়েও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মেহেদী হাসান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, এই মামলার এজাহার লেখা থেকে শুরু করে, তদন্ত পর্যন্ত সর্বত্র গাফিলতি, উদাসীনতা ভুলভ্রান্তি ও অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে সবাই। অথচ এ ধরনের একটি ঘটনায়, নিকট অতীতেই আমরা সাড়ে ৮ কেজি কোকেন মামলার তদন্ত করে দ্রুততম সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে সব আসামিকে ধরেছি। তদন্ত করে চার্জশিট দিতে সক্ষম হয়েছি। ওই কোকেনের চালানের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনেছি। তারা সবাাই এখনো কারাবন্দি।
মাদক বিভাগের পক্ষেই সম্ভব এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মামলার সুষ্ঠু তদন্ত শেষে আাসামি গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে সেই ধরনের প্রয়োজনীয় দক্ষ ও পেশাদার কর্মকর্তা রয়েছে। তারা বিশেষায়িতভাবে এ ধরনের মামলা তদন্ত করে অভ্যস্ত। কিন্তু আমরা হতাশ হয়েছি,পুলিশ আমাদের কাছ থেকে তদন্ত সংক্রান্ত কোনো ধরনের সহযোগিতাও চায়নি।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও নামকাওয়াস্তে আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাকে যেই ঢাকার যেই হোটেলে থাকার কথা ছিল, সেটার বুকিং কে দিয়েছে, সেটাও নিশ্চিত করতে পারেনি তদন্ত কর্মকর্তা। অথচ ওই হোটেলে গিয়ে লেজার বুক থেকে বৃকিং সংক্রান্ত তথ্য নিয়েই কোকেন রহস্য উদ্ঘাটন করার বড় সুযোগ ছিল।
এ ধরনের এজাহার দেখে মাদকের শীর্ষ কর্তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, শুল্ক গোয়েন্দার সঙ্গে ওই রাতের অভিযানে মাদকদ্রব্য নিযন্ত্রণের অধিদপ্তরের কর্তারাও উপস্থিত ছিল। এমন গুরুত্বপূর্ণ কোকেন চালান জব্দ করার সময় যতটা গুরুত্ব দিয়ে আদ্যন্ত সব দায়িত্বপালন করা বাধ্যতামূলক ছিল সেটা করেনি শুল্ক গোয়েন্দার সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার এস আই মাজেদ দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, সত্যিকার অর্থে এ ঘটনায় একমাত্র আসামি পেটুলা স্টাফলকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ঢাকায় কে তার কাছ থেকে কোকেনের চালান বুঝে নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিল তাকেও ধরা যায়নি। তবে এ চালান ঢাকার জন্য আনা হয়নি। ঢাকা হয়ে অন্য একটি দেশে চালান পৌঁছে দেওয়ার জন্যই আনা হয়েছিল। আসামি ঢাকার কাউকে চিনে না বললে দাবি করলেও আমরা তথ বিশ্লেষণে ক’জনের নাম-ঠিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছি। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টাও চলছে।
পেটুলা উত্তরা ১০ নং সেক্টরের হোটেল সি সেলে ওঠার জন্য বুকিং দিয়েছিল। সেটা ঢাকার কেউ দেয়নি। অনলাইনে নাইজিরিয়া থেকে অন্য এক পার্টি এই বুকিং দিয়েছিল । এ জন্য বুকিং সূত্র ধরে কাউকে চিহ্নিত বা ধরা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, গত ২৬ আগস্ট রাতে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিপুল পরিমাণ কোকেনসহ গ্রেপ্তার করা হয় গায়ানার নাগরিক ক্যারেন পেটুলা স্টাফলকে (৬৩)। তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আগেই সতর্ক ছিল শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের লোকজন। কাতার এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে (কিউআর ৬৩৮) রাত আড়াইটারদিকে শাহজালালে নামেন ওই নারী। ফ্লাইটটি শাহজালালের ৬ নম্বর বোর্ডিং ব্রিজে সংযুক্ত হলে ওই যাত্রীর আসন নম্বর ৩০-এ গিয়ে ক্যারেন পেটুলা স্টাফলের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর তার ব্যাগেজ স্ক্যান করা হয়। ক্যারেন পেটুলা স্টাফলের লাগেজে প্লাস্টিকের তিনটি জার পাওয়া যায়।
জারের ভেতরে ২২টি ডিম্বাকৃতির ফয়েলে মোড়ানো ছিল কোকেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এয়ারপোর্ট ইউনিট প্রাথমিক পরীক্ষায় কোকেনের বিষয়টি নিশ্চিত করে। উদ্ধার হওয়া কোকেনের ওজন ৮ কেজি ৬৬০ গ্রাম, যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক হওয়া কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান এটি। এ ঘটনায় পরদিন বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি দায়ের করেন শুল্ক গোয়েন্দার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা জানিবুল হক। মামলায় আসামিকে তিনদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। কিন্তু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষেও কোনো ধরনের তথ্য আদায় করতে পারেনি।
অথচ মাদক বিভাগ জানিয়েছে ওই নারী একজন আন্তর্জাতিক মাদককারবারি। তিনি বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে অন্য একদেশে ওই কোকেনের চালান নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই ঢাকায় ধরা পড়ে যান।
জানা গেছে- এ ধরনের মাদক বাণিজ্য তার এটাই প্রথম নয়। তিনি পেশাদার আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের সদস্য।
এর আগেও একই অপরাধে তাকে নিজের দেশ গায়ানায় জেল খাটতে হয়েছিল। ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ঘায়োনার চেডি জগন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কোকেন পাচারের অভিযোগে তাকে ৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ২.৩ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর গায়ানার চেদ্দি জাগান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১ দশমিক ১৪২ কেজি (২ দশমিক ৫ পাউন্ড) কোকেনসহ ধরা পড়েছিলেন স্টাফল। দোষ স্বীকার করে নিলে দেশটির আদালত তাকে চার বছরের কারাদণ্ড এবং ২৩ লাখ ডলার জরিমানা করে। সেবার কোকেন নিয়ে নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা করার পথে ধরা পড়েন গায়ানার এই নারী। তার কয়েক বছর পর এবার কাতারের দোহা থেকে ঢাকায় এসে তিনি কোকেনসহ ধরা পড়েছেন।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ গায়ানার নাগরিক ক্যারেন পেটুলা স্টাফল (৬৩) পেশায় একজন হেয়াড্রেসার। আগেরবার তার কোকেনসহ ধরা পড়ার ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় স্ট্যাব্রোয়েক নিউজ নামের একটি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইটে। তাতে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে নিউইয়র্কে যাওয়ার জন্য গায়ানার চেদ্দি জাগান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান স্টাফল। চেক-ইন স্ক্যানারে যাওয়ার সময় স্টাফলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং পরে তাকে তল্লাশি কক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে তার শরীর তল্লাশি চালিয়ে নিচের অংশ থেকে প্লাস্টিকে মোড়ানো একটি বস্তু পাওয়া যায়। সেটি খোলার পর ভেতরে সাদা গুঁড়াসদৃশ বস্তু পাওয়া যায়, যা কোকেন সন্দেহে জব্দ করা হয়। প্রাথমিক পরীক্ষায় সেটি কোকেন প্রমাণিত হলে স্টাফল বলে ওঠেন, ‘আমার কাছে এটুকুই কোকেন আছে।
এরপর তাকে গ্রেপ্তার করে গায়ানার কাস্টমস অ্যান্টি-নারকোটিক ইউনিটের (ক্যানু) সদর দপ্তরে নেওয়া হয় এবং মাদকের ওজন মাপা হয়। পাশাপাশি শরীর এক্স-রে করে তার অন্ত্রে সন্দেহজনক বস্তুর উপস্থিতি ধরা পড়ে। এরপর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে জোলাপ খাওয়ানো হলে মলের সঙ্গে দুই দিনে ১০০টি কোকেন ভর্তি ক্যাপসুল বেরিয়ে আসে। পরে সেগুলোর ওজন করে ৯২৮ গ্রাম কোকেন পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া কোকেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ দশমিক ১৪২ কেজি।
মাদকের মামলা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হলে আইনজীবীর পরামর্শে দোষ স্বীকার করে নেন স্টাফল। অপরাধের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে প্রতিশ্রুতি দেন, এমন কাজ আর কখনো করবেন না। ওই বছর ১৪ সেপ্টেম্বর দেওয়া রায়ে আদালত তাকে চার বছরের কারাদণ্ড এবং ২৩ লাখ ৯৮ হাজার ৩০০ ডলার জরিমানা করে। এ ছাড়া তার সঙ্গে পাওয়া ৪০০ মার্কিন ডলার বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেয়। সাত বছরের মাথায় দেখা যাচ্ছে আদালতকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেননি গায়ানার এই নারী। আবারও তিনি মাদক পাচারের পুরানো কারবারে ফিরে গেছেন।
এদিকে এ মামলা এজাহার ও তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইনজ্ঞরা বলছেন, এই মামলাটির এজাহারের বড় ধরনের ত্রুটি ও তদন্তে গাফিলতির দরুন আসামি খুব সহসাই আদালত থেকে জামিন পেয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। কারণ আদালতে এজাহারের দায়েরকৃত অভিযোগ সঠিকভাবে উপস্থাপন করে যুক্তিতর্ক দিয়ে অভিযোগ প্রমাণিত করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যেটাকে বলা হয়, এজাহারের ভুলের দরুন মামলা মেরিট নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, হতে পারে সেটা ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত।