Image description

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের বেশির ভাগ সুপারিশই আইনে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরইমধ্যে এ প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আইন মন্ত্রণালয়েও এ নিয়ে খসড়া বিল প্রণয়নের কাজ চলছে। অনুমোদনের জন্য অক্টোবর মাসের মধ্যেই উপদেষ্টা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করা হতে পারে। প্রথমে অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটাকে আইনে রূপান্তর করা হলেও পরে জাতীয় নির্বাচনের পর সংসদ গঠিত হলে সেখানে বিল আকারে উপস্থাপন করে সংসদের অনুমোদন নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়াসহ প্রতিষ্ঠানটির সংস্কারে অন্তত অর্ধশত সুপারিশ করে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন। এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। যে প্রতিবেদনে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকে চৌর্যতান্ত্রিক (ক্লেপ্টোক্রেটিক) সরকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দুদক গঠনের পর থেকে সংস্থাটি স্বাধীনতা, কার্যকারিতা ও দক্ষতা নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখে ছিল। যার মধ্যে কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। পর্যাপ্ত জনবল ও প্রযুক্তির অভাব, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা ছাড়াও মামলা নিষ্পত্তিতে সময়ক্ষেপণ, রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ এবং দায়বদ্ধতার সংকট রয়েছে। তবে যত সংস্কারই করুক না কেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে, আইন থাকার পরও সেগুলো বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে সংস্কার কাগুজে আইনে পরিণত হবে।

 

দুদকের আইন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন দুদককে সংস্কারে যেসব সুপারিশ ও প্রস্তাবনা দিয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এ নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে মতামতও দেওয়া হয়েছে। যেগুলোতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা দরকার সেটাও জানানো হয়েছে।

দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গৌরবময় জুলাই ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে চৌর্যতান্ত্রিক (ক্লেপ্টোক্রেটিক) সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ এখন একটি নতুন যাত্রার সন্ধিক্ষণে। এই নতুন যাত্রার সোপান বিনির্মাণে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনও বিকল্প নেই। সেই উদ্দেশ্যে দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের ৩ অক্টোবর গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন’ গঠন করে। এই সংস্কার কমিশন দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা, আইনি কাঠামো, কার্যপদ্ধতি, জবাবদিহি, আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও সক্ষমতা, অভ্যন্তরীণ সুশাসন, পেশাগত দক্ষতা, দুর্নীতি প্রতিরোধী ভূমিকা এবং আন্ত-এজেন্সি সমযোগিতা ও সমন্বয়কে চিহ্নিত করে। প্রতিবেদনে উত্থাপিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য ছয় মাস থেকে ৪৮ মাসের মধ্যে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি (৬ মাস, ১৮ মাস ও ৪৮ মাস) পথরেখাও প্রস্তাব করা হয়।

বিশেষ করে দুর্নীতি যে শুধু শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সব ধর্মীয় মানদণ্ডে একটি অগ্রহণযোগ্য, ঘৃণ্য, বৈষম্যমূলক, ধ্বংসাত্মক ও বর্জনীয় ব্যাধি, এই মানসিকতার বিকাশে সব সম্ভাব্য, আকর্ষণীয় ও উদ্ভাবনী মাধ্যম ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কৌশলগত এবং টেকসই প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনায় দুদককে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। ন্যূনতম একজন নারীসহ দুদক কমিশনারের সংখ্যা তিন থেকে পাঁচে উন্নীত করতে হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়ভাবে ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপের পক্ষভুক্ত হওয়া উচিত। কোনও ব্যক্তি ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারবেন না। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের পরিবর্তে একটি দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবিরোধী দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করতে হবে। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করে ন্যায়পালকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে। বৈধ উৎসবিহীন আয়কে বৈধতাদানের যেকোনও রাষ্ট্রীয় চর্চা চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন ও প্রতিরোধ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে। যথাযথ আইনি কাঠামোর মাধ্যমে কোম্পানি, ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশনের প্রকৃত বা চূড়ান্ত সুবিধাভোগীর পরিচয়-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি রেজিস্টারভুক্ত করে জনস্বার্থে প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনি আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও নির্বাচনি অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।

সেবা প্রদানকারী সব সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সব সেবা-পরিষেবা খাতের সেবা কার্যক্রম ও তথ্য-ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ (এন্ড-টু-এন্ড) অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে। ‘আনকাক’-এর অনুচ্ছেদ ২১ অনুসারে বেসরকারি খাতের ঘুষ লেনদেনকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দেশে ও বিদেশে আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে বাংলাদেশকে কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডস বাস্তবায়ন করতে হবে। দুদকের নিয়োগ ও গঠন কাঠামো, দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ নেওয়া এবং প্রতিবছর দুদকের কার্যক্রমের মূল্যায়ন নেওয়াসহ অন্তত পঞ্চাশটি সুপারিশ করে সংস্কার কমিশন।

গত ১৪ আগস্ট দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়ে বৈঠক করেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুদক নিয়ে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা আইনে পরিণত করার কাজ চলছে।’ আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘দুদক সংস্কার কমিশন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা দিয়েছে। প্রস্তাবনাগুলো আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে আইনে রূপান্তর করা হবে।’ এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

দুদক সংস্কার কমিশনের দেওয়া সুপারিশ আইনে পরিণত করার বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা নিয়ে দুদকের আইন বিভাগ ও আইন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে দুদকের পক্ষ থেকে যেসব মতামত দেওয়া দরকার, সেগুলো দেওয়া হবে।’ তবে কবে নাগাদ এটা চূড়ান্ত হবে সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি।