Image description

পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণসহ একইসঙ্গে বাহিনী সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ওই প্রতিবেদন জমা দেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন। তিনি বলেন, ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি পুলিশকে তিন হাজারের বেশি আইন নিয়ে কাজ করতে হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী পুলিশকে প্রাণঘাতী অস্ত্র না দেয়া, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। 

এ ছাড়া পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং নজরদারি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ রয়েছে। বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ, পরোয়ান ছাড়া গ্রেপ্তার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা চেয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিশন। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার কাছে ১৫ ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এতে বল প্রয়োগ, আটক ও গ্রেপ্তার, রিমান্ড এবং জিজ্ঞাসাবাদ, জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠন, মানবাধিকার সুরক্ষা, প্রভাবমুক্ত জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী, যুগোপযোগী আইন, দুর্নীতির প্রতিকার, নারী ও শিশুদের সুরক্ষা, পুলিশের নিয়োগ বদলি পদোন্নতিসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। 

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করার ঘটনায় দোষী পুলিশ সদস্য এবং তাদের নির্দেশদাতাদের যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ এটি কেবল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নয় বরং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং পুলিশের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গঠনের জন্য অপরিহার্য। গণ-অভ্যুত্থানের সময় ঘটে যাওয়া সহিংসতা জনগণের মনে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও অবিশ্বাস তৈরি করেছে। দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে এটি ক্ষমতার অপব্যবহারের বৈধতা দেয়ার সমান হবে। যেটা ভবিষ্যতে আরও দমনমূলক আচরণের পথ প্রশস্ত করতে পারে। 

পুলিশের বল প্রয়োগ প্রসঙ্গে বলা হয়, যে পাঁচ স্তরে বল প্রয়োগ করতে হবে তা হলো- পিআরবি ও জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুসারে প্রথম থেকে তৃতীয় স্তরে শারীরিক সংস্পর্শ ব্যতীত অবৈধ জনতাকে বাধা দেয়া; নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা; বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে অবৈধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা। চতুর্থ স্তরে প্রাণঘাতী বা ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করা বিষয়ে বিভিন্ন কৌশলে শক্তি প্রয়োগ করেও অবৈধ জনতা ছত্রভঙ্গ না হলে বরং আরও সংগঠিত হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। মারমুখী আচরণ করলে ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটালে এবং পুলিশ ও সাধারণ জনগণকে আঘাত করে আহত করলে কমান্ডার তার সদস্যদেরসহ কভার নেবেন। ওয়াটার ক্যানন এপিসি ইত্যাদি ব্যবহার করবেন। স্পেসিফিক স্কিল প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। প্রয়োজনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে শটগান, সাউন্ড গ্রেনেড, ইন্ডিভিজ্যুয়াল ফায়ার আর্মস নির্দিষ্ট টার্গেটে ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করবেন। 

আটক তল্লাশি ও গ্রেপ্তারবিষয়ক সুপারিশে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারের সময় আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। আটক বা রিমান্ডে থাকা ব্যক্তিকে কাচের ঘরে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। বন্দিদের আদালতে আনা-নেয়ার যানবাহনের মান উন্নত করতে হবে। নারী আসামিকে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে শালীনতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তল্লাশির সময় পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় না দিতে চাইলে নাগরিক নিরাপত্তায় জরুরি কল সার্ভিস চালু করার কথা বলা হয়েছে। রাতে তল্লাশি করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বা গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। কেস ডায়েরি আদালতে দাখিল করে আদালতের আদেশ ব্যতীত এফআইআর বহির্ভূত আসামি গ্রেপ্তার করা যাবে না। বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য সরাসরি সব পদক্ষেপ মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। পুলিশের প্রধান কার্যালয়ে একটি মানবাধিকার সেল কার্যকর করতে হবে। ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনীর জন্য পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্য পোষণ করে। একটি সংবিধিবদ্ধ না সাংবিধানিক কাঠামো হবে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে।

জিডি ও মামলার বিষয়ে বলা হয়েছে, থানায় জিডি গ্রহণ বাধ্যতামূলক, কোনোক্রমেই জিডি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। মামলার তদন্ত ব্যয় বৃদ্ধি ও ভেরিফিকেশন সংক্রান্ত যাবতীয় ক্রমের থানায় বিশেষ বরাদ্দ ও ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ফৌজদারি মামলার তদন্তের জন্য বিশেষায়িত সেল গঠন করতে হবে। ভবিষ্যতে মামলা পরিচালনা ও তদন্ত একটি ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের অধীনে পরিচালিত হবে। তারা ফৌজদারি মামলা প্রসিকিউশন সংক্রান্ত বিশেষ তদন্ত দল হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রধারী চাকরিপ্রার্থীদের স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানের বাধ্যবাধকতা রহিত করা যেতে পারে। চাকরিপ্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সনদ যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা রহিত করে সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংস্কার করা যেতে পারে। ভেরিফিকেশন সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। 

পুলিশের দুর্নীতি ও প্রতিকার বিষয়ে বলা হয়েছে, পুলিশের কাজকর্মে ইচ্ছাকৃত ব্যত্যয় বা পেশার দুর্নীতি রোধে ওয়াচডগ বা ওভারসাইট কমিটি গঠন করা যায়। এ ছাড়া প্রতিটি থানা বা উপজেলায় একটি সর্বদলীয় কমিটি গড়ে তোলা, যারা স্থানীয় পর্যায়ে ওভারসাইড বডি হিসেবে কাজ করবে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেবে। 

পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত ডোপ টেস্ট ও সাইকোলজিক্যাল টেস্টের আওতায় আনতে হবে। পুলিশ লাইন্স, থানা ক্যাম্প ও ব্যারাকে স্বাস্থ্যসম্মত ও মানবিক কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগ বদলি ও পদোন্নতি বিষয়ে বলা হয়েছে, সহকারী পুলিশ সুপার নিয়োগের ক্ষেত্রে সিভিল সার্ভিস রুলসহ প্রয়োজনীয় বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সভায় আইজিপিকে বোর্ড সভায় রাখতে হবে। এসপি ও ওসিদের পদায়নের ক্ষেত্রে ফিটলিস্ট তৈরি করতে হবে। কনস্টেবল, এসআই ও এসআই পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে একবার উত্তীর্ণ হলে শারীরিক যোগ্যতা সাপেক্ষে তিন বছরের জন্য পদোন্নতিযোগ্য বিবেচনা করতে হবে। নারী পুলিশের সংখ্যা বর্তমানে ১৬ হাজার ৮০১ জন থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ২৯ হাজার ২৪৮ জন করতে হবে। এ ছাড়া টাউন হলে সভা ও নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠন করতে হবে। ‘একদিন পুলিশ হয়ে দেখুন’ ইত্যাদি রোলপ্লে’র মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুলিশের কাজ সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে। কমিউনিটি পুলিশিং, পুলিশের সেবামূলক ও জনবান্ধব কার্যক্রম বাড়াতে হবে। বিবিধ পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, কারাগার ও পুলিশ লাইন্সের মধ্যে যথাসম্ভব দূরত্ব কমাতে হবে। মাদক সংক্রান্ত অপরাধ দমনে ডাটাবেজ তৈরি করা ও বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (ডিসিএমএস) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রবেশের সুযোগ দেয়া অথবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জন্য আলাদা সিডিএমএস চালু করা।