
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দুঃশাসনের সাড়ে ১৫ বছরে ঝিনাইদহে ব্যাপক নিপীড়ন চলে। জঙ্গি তকমা দেওয়ার পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ২১ নেতাকর্মীসহ ৪২ জনকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
একই সময়ে গুম করা হয়েছে তিন শিবির কর্মীকে, যাদের হদিস এখনো পাননি স্বজনরা। এছাড়া জুলাই বিপ্লবের উত্তাল আন্দোলনে এই জেলার তিন যুবক ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ঝিনাইদহে পুলিশের গুলিতে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহত হন শতাধিক ছাত্র-জনতা।
হাসিনার দুঃশাসনের পুরোটা সময়জুড়ে বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের দমনে সাত শতাধিক গায়েবি মামলা দায়ের করে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে বাড়ি ছাড়া করা হয়। ফ্যাসিবাদের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সামাজিক কোন্দলের নামে জেলার ছয় উপজেলার ৪ হাজার ঘর-বাড়ি ভাংচুরসহ লুটপাট চালানোর মাধ্যমে ১৫ সহস্রাধিক মানুষকে গৃহহীন করা হয়।
কেন্দ্রীয় বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সেলে পাঠানো জেলা শাখার খুন-গুমের তালিকা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জেলায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৪২ জন। এর মধ্যে বিএনপির ৫ জন, জামায়াত-শিবিরের ১৬, সাধারণ ব্যবসায়ী ১, সন্ত্রাসী ১৩ এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তি ৭ জন।
বিচার-বহির্ভূত অমানবিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে নিহতদের মধ্যে আছেন ঝিনাইদহ শহরের যুবদল নেতা মিরাজুল ইসলাম মির্জা, ঢাকার শনিরআখড়া এলাকার বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম, কালীগঞ্জ উপজেলার নলভাঙ্গা গ্রামের বিএনপি নেতা রবিউল ইসলাম রবি, ঝিনাইদহ শহরের খাজুরা গ্রামের বিএনপি নেতা গোলাম মোস্তফার ছেলে গোলাম আজম পলাশ ও একই গ্রামের দুলাল হোসেন, হরিণাকুন্ডুর রঘুনাথপুর ইউনিয়ন জামায়াতের সেক্রেটারি ইদ্রিস আলী পান্না, শৈলকূপার শিবিরকর্মী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইফুল ইসলাম মামুন, ঝিনাইদহ শহরের জনপ্রিয় শিবির নেতা ইবনুল পারভেজ, মেধাবী ছাত্র জহুরুল ইসলাম, ডা. তারিক হাসান সজিব, আরাপপুর ক্যাডেট কলেজ পাড়ার ব্যবসায়ী তৈমুর রহমান তুরান, ঝিনাইদহ পলিটেকনিকের ছাত্র আনিছুর রহমান, ঝিনাইদহ শহরের আল মাহমুদ, কালীগঞ্জের ঈশ্বরবা গ্রামের সোহানুর রহমান সোহান, একই উপজেলার বাকুলিয়া গ্রামের শামিম হোসেন, চাপালী গ্রামের আবুজর গিফারী, সদর উপজেলার কালুহাটী গ্রামের হাফেজ জসিম উদ্দীন, সদর উপজেলার অশ্বস্থলী গ্রামের মাদরাসা শিক্ষক ও জামায়াত কর্মী আবু হুরাইরা, কোটচাঁদপুরের বলবাড়িয়া গ্রামের জামায়াত কর্মী হাফেজ আবুল কালাম ও একই উপজেলার চাঁদপাড়া গ্রামের জামায়াত নেতা এনামুল হক বিশ্বাস।
বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের অভিযোগ, সাংগঠনিকভাবে ঝিনাইদহের দক্ষ নেতাকর্মীদের টার্গেট করে আওয়ামী লীগ পুলিশ দিয়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত ছিল অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যরা। বিশেষ করে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মদতে টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে পরিকল্পিত চারটি প্রশাসনিক টার্গেট কিলিংয়ের দায় বিএনপি-জামায়াতের উপর চাপিয়ে দিয়ে ঝিনাইদহকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে র্যাব ও পুলিশ। ২০১৬ সালে মন্দিরের পুরোহিত আনন্দ গোপাল, সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস, খ্রিষ্টান হোমিও চিকিৎসক ডা. সমীর উদ্দীন খাজা ও শিয়া মতাদর্শের হোমিও চিকিৎসক ডা. আবদুর রাজ্জাককে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার পর সেই দায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর চাপিয়ে জেলার আনাচে-কানাচে অভিযানের নামে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়। এমন ভুয়া অজুহাত তৈরি করে চালানো হয়েছে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড।
অভিযোগ আছে, বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করতে সুকৌশলে ঝিনাইদহকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করে স্বৈরাচার হাসিনার সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর যেখানে সেখানে মানুষের গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে থাকত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব হত্যার দায় স্বীকার করত না। উল্টো এর দায় চাপিয়ে জামায়াত ও শিবিরের শীর্ষ বেশ কয়েক নেতাকে গুলি করে হত্যার পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত বলে দাবি করা হয়। পুলিশ জেলাব্যাপী এই বিভীষিকার জন্য সরাসরি জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে জুলুমের শিকার দলটির বিরুদ্ধেই অভিযান চালাত। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল জামায়াত ও বিএনপির ৩ সহস্রাধিক নেতকর্মীকে।
জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী দুঃশাসনের অবসান হলে ঝিনাইদহে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সুপার (চাকরিচ্যুত) আলতাফ হোসেনসহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপার, বিভিন্ন থানার ওসি, এসআই, এএসআই, কনস্টেবল ও ডিবি পুলিশের সদস্যসহ ৪৭ জনের নামে ১১টি হত্যা মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
হত্যাকাণ্ডে দায়ী পুলিশ সদস্য
বন্দুকযুদ্ধের নামে পুলিশের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ পায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। মূলত, ঝিনাইদহ পুলিশ প্রশাসন সেই সময় কথিত জঙ্গি দমনের নামে ঝিনাইদহ জামায়াত-শিবিরের দক্ষ ও সাংগঠনিক নেতাকর্মীকে টার্গেট করে হত্যা করে। ছয় নিরীহ জামায়াত ও শিবির কর্মীকে বিনা বিচারে ও নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় নিহতদের পরিবার ও জামায়াত কয়েক পুলিশ সদস্যকে দায়ী করে। সুনির্দিষ্টভাবে ৬টি হত্যার ঘটনায় ঝিনাইদহের তৎকালীন পুলিশ সুপার (বর্তমানে চাকরিচ্যুত) আলতাফ হোসেন, এএসপি আজবাহার আলী শেখ ও ঝিনাইদহ ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমএ হাসেম খানকে দায়ী করা হয়। এছাড়া সাইফুল ইসলাম মামুনকে হত্যার ঘটনায় ঝিনাইদহ সদর থানার তৎকালীন ওসি হরেন্দ্রনাথ সরকার, ঝিনাইদহ সদর থানার কনস্টেবল ফয়সাল হোসেন ও সুমন হোসেনকে দায়ী করা হয়।
এদিকে বিভিন্ন হত্যার ঘটনায় মহেশপুর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম, মহেশপুর থানার কনস্টেবল সেলিম রেজা ও আহসান হাবিব, কালিগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন, এসআই নীরব হোসেন, মাওলানা ইদ্রিস আলী পান্না হত্যার ঘটনায় হরিণাকুন্ডু থানার ওসি মাহাতাব উদ্দীন, রামচন্দ্রপুর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই অজয় কুমার কুন্ডু, জামায়াত নেতা জহুরুল ইসলাম ও ডা. তারেক হাসান সজিবকে হত্যার অভিযোগ আছে ঝিনাইদহ সদর থানার তৎকালীন ওসি হরেন্দ্রনাথ সরকার, এসআই আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তাছাড়া একাধিক হত্যার ব্যাপারে মহেশপুর থানার কনস্টেবল বুলবুল আহমেদ, আলমগীর হোসেন, আজিম উদ্দিন ও নাসিম হোসেনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তীর রয়েছে।
বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক আলী আজম মো. আবুবকর বলেন, ১৬ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী হত্যার ব্যাপারে এ পর্যন্ত ৯টি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে আসামিদের আটক করার ব্যাপারে পুলিশের চরম অনীহা কাজ করছে। আমরা এটা নিয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকসহ প্রশাসনের কাছে একাধিকবার অভিযোগ দিয়েছি, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। পুলিশ বলছে, উপরের নির্দেশ ছাড়া আসামি আটক করা সম্ভব নয়।
জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আবদুল আউয়াল বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে জামায়াত-শিবিরকে দমন করতে ৩৮৪টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলা হলেও সরকারের নীতির কারণে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। মামলাগুলোর দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ায় এই অনুভূতি তৈরি হয়েছে।
গুমের শিকার যারা
২০১২ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবির কর্মী ওয়ালিউল্লাহ ও আল মোকাদ্দাস এবং ২০১৬ সালের নভেম্বরে ঝিনাইদহ আলীয়া মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র ও ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কালীচরণপুর ইউনিয়নের নাচনা গ্রামের মৃত রুস্তম আলী মল্লিকের ছেলে শিবির কর্মী কামরুল ইসলাম ওরফে কামরুজ্জামান আটক হওয়ার পর নিখোঁজ হন। জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় আজও তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
হাসিনা সরকারের চক্ষুশূল হয়ে ঝিনাইদহের নাচনা গ্রামের মল্লিক পরিবারের সহোদর ৫ ভাইয়ের মধ্যে ৪ জনকে নির্মম রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। নির্যাতিত পরিবারটি গুম হওয়ার আট বছর পরেও খোঁজ পায়নি তাদের ছোট ভাই শিবিরকর্মী কামরুলের।
জুলাই বিপ্লবের পর ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গঠিত গুম কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন কামরুলের চাচা আশরাফুল আলম। যা তদন্তের জন্য এখনো প্রক্রিয়াধীন আছে। তবে কামরুল গুমের ব্যাপারে সম্প্রতি গুম কমিশন ঝিনাইদহ সদর থানা পুলিশের কাছে প্রতিবেদন চেয়ে পাঠিয়েছে বলে আমার দেশকে জানিয়েছেন জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আবদুল আউয়াল।
আয়নাঘরে ছিলেন যারা
জামায়াতের রাজনীতি করায় হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়ে দীর্ঘ সাড়ে ৬ মাস অন্ধকার কুঠুরিতে ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন মাসুদুর রহমান মাসুদ। নির্মম নির্যাতনের শিকার মাসুদ ঝিনাইদহ আলহেরা ইসলামী ইনস্টিটিউটের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও সদর উপজেলার কালীচরণপুর ইউনিয়ন শাখার তৎকালীন সেক্রেটারি ছিলেন। তাকে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট আটক করে র্যাব। এরপর মাসুদের জীবনে নেমে আসে ৬ মাস ১৪ দিনের আয়নাঘর নামে ভয়াল বন্দি জীবনের চরম বিভীষিকা। আটকের পর থেকে চোখ বাঁধা ও হাতে হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় ঝিনাইদহ ক্যাম্পে ৭ দিন নির্যাতনের পর ১৫ আগস্ট মাসুদকে ঢাকায় ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘরে স্থানান্তর করে র্যাব সদস্যরা।
মাসুদ বলেন, এক লিটার পানি দেওয়া হতো ৬ দিন খাওয়ার জন্য। আয়নাঘরে ঠাঁই মেলার দুদিনের মাথায় ৫৫ বছর বয়সি জামায়াত কর্মী মাসুদের হাতের ১০টি আঙুলের নখ প্লাস দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়। লম্বায় ৫ ফুট ও প্রস্থে দেড় ফুট নিকষ অন্ধকার কালো কুঠুরীতে প্রতিদিন তিনবার নিয়ম করে মারধর করা হতো। এর মধ্যে প্রতিদিন প্রথম দফায় দুই পায়ে গুনে গুনে বেতের লাঠি দিয়ে ৬০টি আঘাত করত নির্যাতনকারীরা। ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একটি বাড়ি, ৩০ শতক জমি ও ২টি গরু বিক্রি করে প্রায় ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে মাসুদকে আয়নাঘর থেকে জীবন্ত ফিরিয়ে আনেন তার স্ত্রী।
এদিকে ২০১৭ সালের ৭ মে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় মহেশপুর উপজেলা সদর থেকে ডিবি পুলিশের হাতে আটক হন রুস্তম আলী মল্লিকের চতুর্থ ছেলে মাসুদের ছোট ভাই কাঠ ব্যবসায়ী আশরাফুল আলম। তিনিও ২৭ দিন ডিবির আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন।
জুলাই বিপ্লব
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ঝিনাইদহের তিন যুবক নিহত হন। তারা হলেন- ঝিনাইদহ পৌর এলাকার চাকলাপাড়া সার্কিট হাউসসংলগ্ন বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুবকর সিদ্দিকের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুল হোসেন, ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ২ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের আমোদ আলী মণ্ডলের ছেলে হাফেজ সাব্বির হোসেন ও ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ঘোড়াশাল ইউনিয়নের মুনুড়িয়া গ্রামের বিকাশ চন্দ্র শীলের ছেলে শুভ শীল। হাসিনাবিরোধী উত্তাল আন্দোলন চলাকালীন ১৯ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি গলায় বিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ২৯ বছর বয়সি রাকিবুল হোসেন।
১৮ জুলাই কাকডাকা ভোর থেকেই ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকার রাস্তায় নামেন আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা। দিনভর আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষে এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিকাল ৫টার দিকে উত্তরা আজমপুর ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে পুলিশের টিয়ারশেলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখন আত্মরক্ষায় ব্যস্ত ঠিক তখন ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা ছাত্রছাত্রীদের ওপর টার্গেট করে গুলি চালায়। এ সময় হঠাৎ একটি বুলেট এসে হাফেজ সাব্বিরের গলায় বিদ্ধ হলে তিনি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।
২০ জুলাই সকাল থেকেই সাভার এলাকা ছিল রণক্ষেত্র। এলাকার সব স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা সেদিন রাস্তায় নেমে একযোগে আওয়াজ তুলেছিলেন স্বৈরাচার হাসিনার পতনের। ফ্যাসিবাদের দোসর পুলিশ সেদিন কোনোভাবেই ছাত্রদের সাভার এলাকায় সমবেত হতে দিচ্ছিল না। সেদিন বিকাল ৪টার দিকে ছাত্রদের মিছিলে ধাওয়া দেয় পুলিশ। প্রাণভয়ে শুভ শীল অন্যদের সঙ্গে আশ্রয় নেন সাভার বাসস্ট্যান্ডের সামনের একটি বন্ধ মার্কেটে। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি তিনি। দুই পুলিশ তাকে বেল্টে বেঁধে রাস্তায় নিয়ে নির্মমভাবে পেটায়। অচেতন শুভকে মৃত ভেবে ফেলে যাওয়ার সময় এক পুলিশ সদস্য শুভর পেট লক্ষ্য করে রাইফেলের গুলি চালায়।
আহতদের ব্যাপারে পুলিশ এতই ক্ষুব্ধ ছিল যে আহত শুভকে হাসপাতালে লোহার বেডের সঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়। এভাবে তিনদিন পর সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই ভোরে মৃত্যু হয় তার।
অন্যদিকে জুলাই আন্দোলন চলাকালে ৪ ও ৫ আগস্ট ঝিনাইদহ ও মহেশপুর উপজেলা শহরে পুলিশের গুলিতে প্রায় শতাধিক ছাত্র-জনতা আহত হন। তাদের মধ্যে ১০ জন গুরুতর জখম হন।
বাড়িঘর ভাঙচুর-লুটপাট
হাসিনার শাসনামলে এলাকাভিত্তিক আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও সামাজিক কোন্দলের জের ধরে গ্রামাঞ্চলের বাড়িঘরে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার বাসিন্দারা।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, শৈলকূপায় হাসিনার দুঃশাসনের সাড়ে ১৫ বছরে প্রায় দুই হাজার ঘরবাড়ি ও বসতভিটা ভাঙচুর করে লুটপাট করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। সব মিলিয়ে জেলায় গৃহহীন হয়েছে ১৫ সহস্রাধিক মানুষ।
হাসিনার দুঃশাসনের ভয়াবহতা উল্লেখ করে জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট এমএ মজিদ বলেন, হাসিনার দুঃশাসনের সাড়ে ১৫ বছরের চিত্র জেলাবাসীর কাছে ভয়াবহ অধ্যায়। জেলা বিএনপির উদ্যোগে এ ব্যাপারে যাচাই-বাছাই ও তথ্য সংগ্রহ চলছে। ইতোমধ্যে কিছু কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আওয়াল বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় হাসিনা সরকারের আমলে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে কাজ শেষ করেছে। অন্যান্য বিষয়েও মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ চলছে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন কালিগঞ্জ প্রতিনিধি টিপু সুলতান, কোটচাঁদপুর প্রতিনিধি কাজী মৃদুল, মহেশপুর প্রতিনিধি বাবর আলী, হরিনাকুন্ডু প্রতিনিধি মকলেচুর রহমান লাড্ডু ও শৈলকূপা প্রতিনিধি আবদুল মান্নান]