
ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন অপ্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক দলের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে নীরব প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল, তা এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। দু-দলই পরস্পরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। এতে মাঠপর্যায়ে দু-দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন তিক্ত হয়ে উঠছে। এতে ঘি ঢালছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দু-দলের সমর্থকদের নানা ধরনের অর্বাচীন মন্তব্য। অথচ হাসিনার দেড় দশকের শাসনের বেশির ভাগ সময় দু-দলের নেতারা একসঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। দু-দলের নেতারা নির্যাতন, নিপীড়ন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে বাংলাদেশ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাতে সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু এখনো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ চলছে, যা দেশের রাজনীতিতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এরই মধ্যে আমরা ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সরকারে যারা কলকাঠি নেড়েছিল, তাদের তৎপরতা দেখতে পারছি।

যদিও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে দু-দলের সম্পর্কে শীতলতা আসে। এ সময় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি একটি নির্বাচনি জোট গঠন করে। এই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করে। কার্যত এই নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের অংশগ্রহণের মাধ্যমে হাসিনা আরো দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন। একই সঙ্গে দু-দলের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে।
হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সবসময় বলা হতো, বিএনপিকে জামায়াত ছেড়ে আসতে হবে। তাহলে শুধু তাদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অর্থাৎ জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে যে রাজনৈতিক বোঝাপড়া এবং ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাকে সবসময় ভয় পেতেন হাসিনা। আমরা দেখছি, পরবর্তী সময়ে এই ঐক্য আর ধরে রাখা যায়নি। বিএনপির ভেতরে থাকা ভারতের প্রতি দুর্বল বাম ধারার নেতারা ছিলেন এই ঐক্যের পথে বড় বাধা। এই সুযোগে হাসিনা তার শাসন দীর্ঘায়িত করার সুযোগ পেয়েছেন। আবার হাসিনার পতন তখনই হয়েছে, যখন দু-দলের নেতাকর্মীরা একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন। এ কথা সত্য, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে শুরু হয়নি। কিন্তু এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়েছে রাজনৈতিক ছাত্র নেতৃত্ব।
হাসিনার পতনের সময় গড়ে ওঠা আন্দোলনে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তা যেন দিন দিন ফিকে হয়ে উঠছে। এই সুযোগে পলাতক ফ্যাসিস্টরা যেমন সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে, তেমনি সুশীল সমাজের আড়ালে তৃতীয় পক্ষ যেন সরব হয়ে উঠেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ওয়ান-ইলেভেনের পর দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থিরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। হাসিনা ও তার দলকে ২০০৮ সালে একটি রহস্যজনক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আনা হয়েছিল। এর আগে বেগম খালেদা জিয়াকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করতে না পেরে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। তারেক রহমানের ওপর চালানো হয়েছিল ভয়াবহ নির্যাতন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জামায়াত নেতাদের হত্যার নীলনকশা তখনই তৈরি করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে জেনারেল মঈন প্রথম যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলেছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যখন বিরোধ দেখা দিয়েছে, তখন দেশে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৯২ সালে বিএনপির কিছু নেতার ইন্ধনে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন ও গণআদালত প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর পরিণতিতে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সংসদ বর্জন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে আন্দোলন করেছিল জামায়াত। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি-জামায়াতের ভোট বিভাজনের সুযোগ নিয়ে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল।
একইভাবে ২০০৮ সালে নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে মতভিন্নতা ছিল। মঈন উদ্দিন- ফখরুদ্দিন সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার বিপরীতে শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি দল দুটি। এর ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতায় আসেনি, বাংলাদেশ পুরোপুরি ভারতের রাডারের আওতায় চলে যায়। বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে নতুন যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে জাতীয় ঐক্য এখন আরো বেশি প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এ কথা সত্য, আওয়ামী লীগ না থাকায় বিএনপি ও জামায়াত এখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। দু-দলের রাজনৈতিক দর্শন ভিন্ন। স্বাভাবিকভাবে আগে দল দুটির মধ্যে যে ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তা এখন বাস্তব কারণে সম্ভব নয়। কিন্তু জাতীয় ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে যদি অনৈক্য তৈরি হয়, তাহলে দেশ এক ভয়ংকর বিপদের মুখে পড়তে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত অতীতে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এই দেশের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে এমন নানা শক্তির সঙ্গে ভারত সবসময় বিশেষ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে। হাসিনার পতন ও পলায়নের পর বাংলাদেশের ওপর ভারত তার নিয়ন্ত্রণ অনেকটা হারিয়ে ফেলে। এখন আগামী নির্বাচন ঘিরে ভারত তার সফট পাওয়ারগুলো সক্রিয় করার চেষ্টা করছে। ড. ইউনূসের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কিছু সিদ্ধান্ত ভারতকে ক্ষুব্ধ করে তুলছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর ড. ইউনূসের সরকারের বিরুদ্ধে ভারত সরকার ও গণমাধ্যম যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সম্ভাবনাকে ভারত এখন ভীতির চোখে দেখছে। ফলে নির্বাচনের আগে ড. ইউনূস সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়ার সব চেষ্টা ভারত করতে পারে।
আমরা দেখছি, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থার উত্থান ঘটছে বলে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে দিল্লি। বাংলাদেশে ইসলামপন্থি রাজনীতি নতুন কোনো ঘটনা নয়। ইসলামপন্থিরা সবসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইসলামপন্থি দলগুলোর রাজনৈতিক অধিকারকে এই দেশের মানুষ সমর্থন করে। যদিও তারা কখনোই ইসলামপন্থি দলগুলোকে বিপুলভাবে বিজয়ী করেনি। কিন্তু হঠাৎ করে যেন ইসলামপন্থিদের উত্থান নিয়ে নতুন করে প্রচার শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচনে ইসলামপন্থি ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয়ের পর ভারতের রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে নানামুখী প্রতিক্রিয়া আসছে। অথচ ভারতে দেড় দশক ধরে একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় আছে।
আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে ভারতের সফট পাওয়ারগুলো বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে দ্বন্দ্ব আরো তীব্র রূপ দেওয়ার চেষ্টা করবে। এই ফাঁদে যদি দল দুটি পড়ে যায়, তাহলে দেশ এক গভীর সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। আমরা লক্ষ করছি, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও আনুপাতিক হারে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে জামায়াত এবং বিএনপির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে কয়েকটি দল রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এসব দাবির কয়েকটির সঙ্গে আবার এনসিপির সমর্থন আছে। অর্থাৎ বিএনপির অবস্থানের বিপরীতে শক্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। তবে আশার কথা হলো, উভয় পক্ষ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে একমত হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান কর্তব্য হচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করা। ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে না রাষ্ট্র সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মাঠের আন্দোলনের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা। এই সুযোগে অস্থিরতা সৃষ্টি করে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে পারে। আবার বিএনপির উচিত হবে না এমন কোনো কঠোর অবস্থান নেওয়া, যাতে দলগুলোকে আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। সত্যি কথা হচ্ছে, হাসিনা-পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে বিএনপির যে অভিভাবকসুলভ ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ছিল, তা দেখাতে দলটি ব্যর্থ হয়েছে। দেশের এই ক্রান্তিকালে বিএনপি যদি সব দল নিয়ে সংস্কারবিষয়ক জটিলতার অবসান ঘটাতে না পারে, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ শুধু অনিশ্চিত হবে না, দল হিসেবে বিএনপিও সংকটে পড়বে।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ