Image description

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুলাই শহীদ আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলানোর চেষ্টাকারীরা বহাল তবিয়তে থাকায় জনমনে ক্ষোভ বাড়ছে। তাদের মধ্যে অন্যতম রংপুর মেট্রোপলিটনের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের (এসবি) তৎকালীন এসপি আবু বক্কর সিদ্দিক। চিকিৎসককে রিপোর্ট বদলানোর জন্য নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো পুলিশের এই কর্মকর্তা বর্তমানে ময়মনসিংহ রেঞ্জ অফিসে কর্মরত। পেয়েছেন এডিআইজি পদে পদোন্নতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আবু সাঈদ । এরপর ময়নাতদন্তের জন্য তার লাশ রংপুর মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠায় পুলিশ। সেখানে কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিবুল ইসলামকে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলানোর জন্য ভয়ভীতি দেখান আবু বক্কর । এর মাধ্যমে তিনি রিপোর্ট ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন ওই চিকিৎসক। এর পরও অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে তিনি এখনো বহাল আছেন।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবু বক্করকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার এডিআইজি হিসেবে প্রমোশন দেয়। এরপর তাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন ছাত্র-জনতা। পরে তাকে বদলি করে রংপুর রেঞ্জে এডিশনাল হিসেবে সংযুক্ত করা হয়। এরপরও ছাত্র-জনতার আন্দোলন অব্যাহত থাকায় তাকে ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশ অফিসে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে।

 

আবু সাঈদের সহপাঠী অয়ন ও সুমন জানান, প্রকাশ্যে পুলিশ আবু সাঈদকে গুলি করেছে সেটি সবাই আমরা দেখেছি। এরপর এসবির পুলিশ সুপার আবু বক্কর ডা. রাজিবুল ইসলামকে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটি বদলাতে ভয়-ভীতি দেখিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে সেই ডাক্তার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু সেই পুলিশ কর্মকর্তা এখনো বহাল রয়েছেন। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা চাই আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।

 

সম্প্রতি আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তৈরি করা ডা. রাজিবুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আদালতকে তিনি বলেন, আমি ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই শহীদ আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত করি। তার শরীরে অনেক পিলেট পাওয়া যায়। পিলেটবিদ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করি। মতামতসহ আমার করা রিপোর্ট তাজহাট থানার তদন্ত কর্মকর্তাকে দিতে গেলে তা গ্রহণ না করে নতুন রিপোর্ট লিখতে বলা হয়। এভাবে তিনবার আমার রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি।

জবানবন্দিতে এ চিকিৎসক আরো বলেন, ৩০ জুলাই রংপুর মেডিকেলের ভাইস প্রিন্সিপালের রুমে রংপুর সিটির এসবির এসপি সিদ্দিক, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি মারুফ, রংপুর মেডিকেলের স্বাচিপ সভাপতি ড. চন্দন আমাকে তাদের মতো করে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিতে চাপ দেন। এ সময় পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা রুমের বাইরে অবস্থান করছিলেন। ওনারা প্রথম থেকেই আমাকে বলেন যে, আবু সাঈদের মাথায় ইনজুরি আছে সেটি ফোকাস করতে হবে। তারা আমাকে তাদের মতো করে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিতে চাপ দেন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। তারা আমাকে আবু সাঈদের বুলেট/পিলেট ইনজুরির পরিবর্তে হেড ইনজুরি ও নিউরোজেনিক শক লিখতে বলেন। বলা হয়, তাদের মতো করে রিপোর্ট না দিলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে। আমার বিষয়ে নাকি গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে।

 

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলাতে একপর্যায়ে নানা প্রলোভন দেওয়া হয় উল্লেখ করে চিকিৎসক রাজিবুল বলেন, তারা আমাকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ঘুরে আসার প্রলোভন দেন। আমি বলি, আমার পাসপোর্ট নেই। তখন তারা আমাকে স্ত্রী-সন্তানের নিয়ে দুই সপ্তাহ কক্সবাজারে ঘুরে আসার অফার দেয়। সবকিছুর ব্যবস্থা তারা করবেন বলে জানান। তবে আমি তাদের কথায় রাজি হইনি। আমি ভাইস প্রিন্সিপালকে বলি, আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য টিভিতে লাইভ সম্প্রচার হয়েছে এবং তা সারা বিশ্ব দেখেছে। আমি যদি এই হত্যাকে হেড ইনজুরি বলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেই তাহলে সারা বিশ্বের মানুষ চিকিৎসক সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখবে।

 

তাকে পেশাগত প্রলোভন দেওয়া হয় উল্লেখ করে চিকিৎসক রাজিবুল বলেন, ড. চন্দন আমাকে বলেন, নেত্রী তোমার ব্যাপারে কনসার্ন। তোমার ব্যাপার আমরা দেখব। পুলিশ যেভাবে চায় সেভাবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দাও। কিন্তু এতকিছুর পরেও আমি আমার জায়গা থেকে সরে যাইনি। সর্বশেষ দেওয়া পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আমি আবু সাঈদের শরীরে পিলেট ইনজুরির বর্ণনা দেই। তবে রিপোর্টে ‘গান শট’ শব্দটা লিখিনি।

 

ওই চিকিৎসক আরো বলেন, আমার স্ত্রী ও দুটি সন্তান আছে। তখনকার ওই সরকার থাকলে এখন আমার কী হতো? আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য রিপোর্ট প্রদান করেছি। আমি আবু সাঈদ হত্যার নির্দেশ দাতাসহ জড়িতদের বিচার ও শাস্তি চাই।

আবু সাঈদ হত্যায় জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক ইমরান হোসেন। তিনি আমার দেশকে জানান, পুলিশ এখনো পরিবর্তন হয়নি। পুলিশের মধ্যে এখনো ঘাপটি মেরে আছে জুলাই বিরোধী অনেক কর্মকর্তা। আবু সাঈদের হত্যার সঙ্গে জড়িত ও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলানোর কারিগর আবু বকর সিদ্দিকসহ সব পুলিশ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে আবার ছাত্র-জনতা মাঠে নামবে।

 

জড়িতদের শাস্তি চেয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য এবং উত্তরাঞ্চলের সহকারী পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল আমার দেশকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ইতিমধ্যে আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তৈরিকারী চিকিৎসক জবানবন্দি দিয়েছেন। এতকিছুর পরও অপরাধীরা বহাল তবিয়তে রাখার কারণে পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা আরো কমে যাচ্ছে।

 

রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামু আমার দেশকে বলেন, পুলিশের কর্মকাণ্ড দেখে বলাই যায় যে, বাহিনীটি এখনো বদলায়নি। আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলাতে চাপ প্রয়োগকারী পুলিশ কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিকসহ যারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের মধ্যে অনেকেই পুলিশের উপর মহলে বসে আছে। আমরা চাই দ্রুত আবু সাঈদের হত্যা এবং তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদল করার চেষ্টা যারা করেছেন তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।

 

শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, ‘পৃথিবীর সব মানুষ দেখেছে প্রকাশ্যে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। আবু বক্কর সিদ্দিকসহ পুলিশের কর্মকর্তারা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদল করে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ‌আবার সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে কীভাবে এই অন্তর্বর্তী সরকার প্রমোশন দিয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি করতে পারে? এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা চাই রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সাবেক এসপি আবু বক্করকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।’

 

এ বিষয়ে পুলিশের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, পুলিশের একটি মহল আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলে মামলাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের উচিত দ্রুত আবু বক্কর সিদ্দিকের মতো পুলিশ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা। তাকে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আসল রহস্য বের হয়ে আসবে।

 

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এসবির সাবেক এসপি আবু বক্কর সিদ্দিককে অভিযোগের প্রসঙ্গে জানতে কল করা হলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।