
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঢাকায় কোচিং করতে এসেছেন চুয়াডাঙ্গার মেয়ে রাইসা ইকবাল। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার বিভিন্ন হোস্টেলে খোঁজ নিলেও অতিরিক্ত ভাড়া আর কঠিন সব শর্তের কারণে মেয়ের জন্য কোনো আসন রিজার্ভ করতে পারেননি তার মা-বাবা। এ অবস্থায় আবাসন নিয়ে বিপাকে পড়েন উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসা এই ছাত্রী।
মা ঝর্না ইকবাল জানান, একটি রুম নয়, শুধু একটি আসনের জন্য ৮ থেকে ১৩ হাজার টাকা ভাড়া চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে রাইসার ঢাকায় থাকার পরিকল্পনা, অথচ হোস্টেল কর্তৃপক্ষ ডিসেম্বর মাসের ভাড়াও চাইছে। তার ওপর সার্ভিস চার্জ হিসেবে আরো ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে
ঝর্না ইকবাল আমার দেশকে জানান, রাইসা বর্তমানে উত্তরায় তার খালার সঙ্গে থাকছে। এ কারণে উত্তরা থেকে প্রতিদিন ফার্মগেট আসা-যাওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা আর খরচ এড়ানোর জন্য তারা ফার্মগেট এলাকার কোনো হোস্টেল খুঁজছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন আর চাচ্ছি না মেয়ে কোনো হোস্টেলে থাকুক। বরং আমরা এই এলাকায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেব, যেখানে সে তার আরেক বন্ধুর সঙ্গে থাকবে। ওদের সঙ্গে এই কয়েক মাসের জন্য আমার বোনও এসে থাকবে।’
রাইসার মতো প্রতিবছর এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে কাঙ্ক্ষিত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে ঢাকায় আসেন। তাদের একটি বড় অংশের গন্তব্য রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা। কারণ, রাজধানীর অধিকাংশ কোচিং সেন্টারের প্রধান শাখা ওই এলাকাতেই। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে তাদের অনেকেই কোচিং সেন্টারগুলোর ফার্মগেট শাখায় এসে ভর্তি হলেও সমস্যা দেখা দেয় থাকার জায়গা নিয়ে। ঢাকায় বিকল্প কোনো উপায় না থাকায় তিন থেকে চার মাসের থাকা-খাওয়ার জন্য তাদের বেছে নিতে হয় কোচিং বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রাইভেট হোস্টেলগুলোকে। চটকদার বিজ্ঞাপনে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, সার্বক্ষণিক পানি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা বলে রাজধানীর অলিগলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বহু ছাত্রী বা কর্মজীবী নারীদের আবাসিক হোস্টেল। বিজ্ঞাপন দেখে আকৃষ্ট হয়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে রেখে যাচ্ছেন এসব হোস্টেলে। ছেলে বা মেয়ে সবার জন্যই এটা সমস্যা, তবে স্বাভাবিকভাবেই মেয়েদের জন্য পরিস্থিতি অনেক বেশি কঠিন।
আবার অনেকেই সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেও মিলছে না আবাসন। এতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর থাকতে হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন হোস্টেলে। কিন্তু হোস্টেলগুলোর অধিকাংশই নোংরা, অন্ধকার, নিরাপত্তাহীনতা ও দম বন্ধ পরিবেশ। হোস্টেল কিংবা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন সংগ্রামের সঙ্গে নিরাপত্তাহীনতা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরও বিচলিত করছে। এসব মনিটরিং করার মতো দেশে কোনো সংস্থা নেই। বহু হোস্টেল পরিচালিত হচ্ছে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে। টাকা খরচ করে ছাত্রীরা এসব হোস্টেলে থাকলেও নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকতে হয়। বেশিরভাগ হোস্টেলেই নেই মানসম্মত পরিবেশ, উপযুক্ত আবাসিক সুবিধা। অথচ শিক্ষার্থীদের সংকটকে পুঁজি করে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করেন মালিকরা।
রাজধানীর ফার্মগেট, মনিপুরীপাড়া, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, আজিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, বহুতল ভবনের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেল করা হয়েছে। দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমসহ ১২টি সিট বসানো হয়েছে। যে ফ্ল্যাটে চার থেকে ছয়জন শিক্ষার্থীর সিট থাকার কথা সেখানে গাদাগাদি করে ১২টি সিট বসানো হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব হোস্টেলে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের জিম্মি করে ‘গলা কাটা’ ব্যবসা চালানো হচ্ছে।
আবার অনেক শিক্ষার্থী কয়েকজন মিলে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েও থাকছেন। এসব এলাকায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় দুই কক্ষের একটি বাসা ভাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু ছাত্রী হোস্টেলে একটি কক্ষে চার থেকে ছয়জনকে সিট ভাড়া দিয়ে আদায় করা হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট এলাকা শিক্ষার্থীদের জন্য একটা ‘হাব’ হিসেবে পরিচিত হলেও বছরজুড়ে এ এলাকায় কতজন শিক্ষার্থী থাকেন কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার পর ঠিক কত শিক্ষার্থী এখানে আসেন, তা নিয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এলাকার কাউন্সিলর বা সংশ্লিষ্ট থানায় নেই। কোচিং সেন্টারগুলোকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারাও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে চায় না।
ফার্মগেট, রাজাবাজার, গ্রিনরোডে মোটামুটি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় দুই কক্ষের একটি চলনসই বাসা ভাড়া পাওয়া যায়। আর ওই এলাকার ছাত্রী হোস্টেলগুলো একটি কক্ষে চার থেকে ছয়জনকে সিট ভাড়া দিয়ে আদায় করে নিচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মৌসুম শুরু হলে হোস্টেল মালিকরা তাদের পুরোনো সেসব বোর্ডারকে সিট ছেড়ে দিতে বলেন, যাতে দ্বিগুণ-তিনগুণ টাকায় সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের সিট ভাড়া দেওয়া যায়।
ফার্মগেটের পরিচিত একটি বেসরকারি হোস্টেল ‘আপন আঙ্গিনা’। কাকলি রহমান নামের এক শিক্ষার্থী সেখানে গত দেড় বছর ধরে আছেন চারজনের রুমে একটা সিট ভাড়া নিয়ে। কিন্তু হোস্টেল কর্তৃপক্ষ এখন তাদের বলছে, জানুয়ারির আগেই সিট ছেড়ে দিতে, নয়তো ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে। কাকলি বলেন, ‘আমার রুমমেট আপুরা আজিমপুরের দিকে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেছে। কারণ সেখানে ভাড়া এখানকার চেয়ে কম। আর তারা তো যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় যেতে পারবে, কারণ তারা ভার্সিটির স্টুডেন্ট। কিন্তু আমার পক্ষে তো সম্ভব না, কারণ আমার পরীক্ষা চলছে। এ ছাড়া কিছু দিন পরেই ভার্সিটি কোচিং শুরু হবে।’
কাকলি জানান, তিনি এ হোস্টেলে ‘পার্মানেন্ট’ হিসেবে থাকেন। সে জন্য খাওয়া আর সিটের জন্য তাকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘ওরা এখন আমার কাছে কোচিংয়ের মেয়েদের মতো ভাড়া চাচ্ছে। বলতেছে যে, কোচিংয়ের তিন মাস সবার মতো করে ১০ হাজার টাকা দেওয়া লাগবে। সঙ্গে সার্ভিস চার্জ হিসেবে আরো ৮ হাজার টাকা দিতে হবে।’
কাকলি বলেন, হোস্টেল কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে এমন আচরণ করতেছে কারণ, তারা জানে যে, আমি পরীক্ষার্থী এবং আমাকে এই এলাকাতেই থাকতে হবে। এখন আমি এখানে থাকতে পারব যদি আমি ১০ হাজার করে সিট ভাড়া দিই, কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমার ফ্যামিলির ওপর প্রেসার পড়ে যাবে।’
হোস্টেল মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতায় আরেকজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী স্বর্ণা। তিনি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ‘মা হোস্টেল’ নামের আরেক ছাত্রী নিবাসে থাকছেন। তিনিও প্রায় একই কারণে ডিসেম্বর মাসেই হোস্টেল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
নিবেদিকা গার্লস হোস্টেলে থাকেন সাথী আক্তার। তিনি জানান, এখন ফার্মগেট ও আশপাশের এলাকার হোস্টেলগুলোতে ভাড়া ও সার্ভিস চার্জসহ প্রথম মাসে গুনতে হয় ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকা। তারও পর অন্তত এক মাসের ভাড়া আগাম দিতে হয়। হোস্টেলের মুখপাত্র আমির হোসেন জানান, তাদের হোস্টেলে সিট পেতে হলে ডিসেম্বর মাস থেকেই বুকিং দিতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে খাবার নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। তিনি বলেন, ‘অলরেডি যারা ভাড়া নিয়েছে, তারা সবাই ডিসেম্বর থেকেই ভাড়া দিতেছে। হ্যাঁ, আমরা জানি যে, ডিসেম্বরের আগে পরীক্ষা শেষ হবে না। শিক্ষার্থীরা জানুয়ারির আগে থাকাও শুরু করতে পারবে না। কিন্তু তাদের ডিসেম্বরের ভাড়া দিতে হবে কারণ এটাই আমাদের সিস্টেম।’ আর খাবারের বিষয়ে আমির হোসেন বলেন, ‘খাবার নেওয়া লাগবেই। এটা একটা প্যাকেজ সিস্টেম।’
এই এলাকার প্রায় সব হোস্টেলেরই চিত্র এমন। এমন নয় যে তারা গোপনে এটা করছেন। এসব শর্ত দিয়ে বছরের পর বছর তারা হোস্টেলের ব্যবসা করে আসছেন। অনেকে হোস্টেলের বিজ্ঞাপনের জন্য ফেসবুকও ব্যবহার করছেন। সমস্যা হলো, এসব নজরদারি বা জবাবদিহিতার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই।