
গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন মোহাম্মদ এজাজ। দায়িত্ব পেয়েই নগর ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন তিনি। ভবিষ্যৎ মেয়রদের জন্য তৈরি করে যাচ্ছেন মাস্টারপ্ল্যান। তবে সরকারি জায়গা দখল, ফুটপাথ, বাজার, মার্কেটে চাঁদাবাজি হাত বদল হয়ে রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। অবৈধ দখল উদ্ধার অভিযান ও চাঁদাবাজি বন্ধে প্রভাবশালীদের বাধা আসছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসি’র এই নতুন প্রশাসক। মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ এসব তথ্য জানান। গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তীতে দায়িত্ব পাওয়ার অভিজ্ঞতার বিষয়ে প্রশাসক এজাজ বলেন, প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগে আমি শহরের মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করতাম, একজন অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে সমস্যাগুলো জানতাম। সমস্যাকে কীভাবে সমাধান করা যাবে তা আমি জানতাম, এখন সুযোগ এসেছে সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করার এবং সমাধান করা। যার ফলাফল নগরবাসী পাচ্ছে। এ ছাড়া গত ৬ মাসে জলাবদ্ধতা নিরসন, বৃক্ষরোপণ, ড্রেনেজ উন্নয়ন, গরিবের আবাসন ও নগর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করেছি। জুলাই অভ্যুত্থান আমাকে এ কাজগুলো করার সুযোগ করে দিয়েছে।
দায়িত্ব নেয়ার ৬ মাসে কি কি কাজ করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রশাসক এজাজ বলেন, গত ছয় মাসে আমরা ৯০টি বাস্তবভিত্তিক কাজ করেছি। এর মধ্যে রয়েছে ২৬টি মাঠ উদ্ধার, খাল উদ্ধার, ২টি লাইব্রেরি স্থাপন (টার্গেট ৫০টি), গাছের ডাক্তার প্রকল্প, ৫ লাখ বৃক্ষরোপণ, ১০০ হিজড়ার জন্য ফুড কাড ব্যবস্থা, সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার, টয়লেট তৈরি করা এবং নারী উদ্যোক্তাদের নার্সারি অনুমোদনসহ নানা উদ্যোগ। তিনি আরও বলেন, গাছের ডাক্তার নামে আমরা একটি প্রজেক্ট শুরু করেছি। কারও বাসায় গাছের সমস্যা থাকলে আমাদের হটলাইন নম্বরে কল দিলে আমরা ফ্রি সার্ভিস দিবো। এ ছাড়া ঢাকা শহরে ঈদের মিছিল হয়েছে শত বছরের পুরাতন সংস্কৃতিকে আমরা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি, পহেলা বৈশাখ নতুন আকারে উদ্যাপন করেছি।
গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ৬ মাসে কি কি পরিবর্তন এনেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘুমিয়ে থাকা সিটি করপোরেশনকে ফাংশনাল করার চেষ্টা করেছি। আমি যদি ১৫ শতাংশ সক্ষমতাকে ৮০ শতাংশে উন্নীত করে যেতে পারি, তাহলেই এটি একটি কার্যকরী প্রতিষ্ঠান হবে। আশা করছি এগুলো আমি করে দিয়ে যেতে পারবো।
পরিকল্পনা করেছিলেন কিন্তু করতে পারেননি এমন কি কাজ আছে- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রশাসক এজাজ বলেন, একটা ইমার্জেন্সি সময়ে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। ঢাকা শহরটি এক ধরনের আইসিইউতে ছিল। প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে সবকিছু যেন ভেঙে পড়েছিল। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কঠিন হলেও আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। তারপরেও আমরা কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। ওয়াসা ও অন্যান্য ইউটিলিটি সংস্থাগুলো সিটি করপোরেশনের অধীনে না থাকায় আন্তঃসংযোগে সমস্যা হচ্ছে। এগুলো নিরসনের জন্য আমরা কিছু কাজ করেছি। তিনি আরও বলেন, ঢাকার সড়কগুলোকে সবুজ করার উদ্যোগ নিয়েছি এবং অন্যান্য যে সরকারি জায়গাগুলো আছে সেগুলো আমরা উদ্ধার করছি। গণপূর্তের অনেক জায়গা আমরা উদ্ধার করে তাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছি। দীর্ঘমেয়াদি অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নযোগ্য হচ্ছে আবার অনেকগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে না। অল্প সময়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা যায় না।
উচ্ছেদ অভিযানে কোনো বাধা পাচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্যেক কাজের মধ্যে বাধা আসছে। শহরের প্রত্যেকটি সরকারি জায়গা, বাসস্ট্যান্ড ও ট্যাম্পু স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে মার্কেট পর্যন্ত বিগত আওয়ামী লীগের আমলে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অধীনে চলতো। এখন এটার হাত বদল হয়েছে, এর ফলে বর্তমান রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। যখন আমরা এগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে চাই, তখন তাদের পক্ষ থেকে বাধা আসছে। ফুটপাথ দখল, চাঁদাবাজির সঙ্গে একটি বড় রাজনৈতিক দল জড়িত। এর ফলে উচ্ছেদ অভিযানগুলো স্থায়ী হচ্ছে না। তবে আমরা থেমে নেই, দখলমুক্ত করার চেষ্টা চলছে।
খাল উদ্ধার এবং ফুটপাথ দখলমুক্ত রাখার স্থায়ী পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, খাল উদ্ধার ও ফুটপাথ নিয়ে আমরা একটা অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছি। আমাদের অঞ্চলে প্রায় ৭টি জায়গায় বড় ধরনের জলাবদ্ধতা ছিল। বিগত সময়ে ধানমণ্ডি ২৭, কালশী, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া এবং উত্তরার একটি অংশে বড় ধরনের জলাবদ্ধতা ছিল কিন্তু এবার জলাবদ্ধতা হয়নি। আমরা এগুলোকে প্রাথমিকভাবে সমাধান করেছি, কিন্তু এটা স্থায়ী নয়। স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধান করার জন্য ড্রেনেজ লাইন এবং খাল নতুন করে খনন করা লাগবে। এগুলোর কাজ চলমান রয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে হারিয়ে যাওয়া একটি নদী পুনরুদ্ধার করেছি।
ট্রাফিক উন্নয়নে পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশাসক এজাজ বলেন, ট্রাফিক উন্নয়নে রোড মার্কিং, ট্রাফিক লাইট স্থাপন, রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ এবং এআই নির্ভর ট্রাফিক সিস্টেম চালুর পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, গুলশান থেকে মগবাজার পর্যন্ত এআই ট্রাফিক সিস্টেম চালু করবো এবং ইতিমধ্যে হাইকোর্ট থেকে শুরু করে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পুরো সড়কে ট্রাফিক লাইট স্থাপন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আগে কোথাও রোডের মার্কিং ছিল না, বাস কোথায় থামবে, জেব্রা ক্রসিং কোথায় হবে এগুলো কিছুই আগে ছিল না। আমরা পুরো ঢাকায় রোড মার্কিং করেছি। আমরা কিছু মোটামুটি ডিজিটাল এবং পুরোপুরি এআই নির্ভর সিস্টেম স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। যেটা ফাংশনাল হবে আমরা সেটা দিয়েই কাজ করবো। এ ছাড়া ডিএমপিকে সঙ্গে নিয়ে আমরা অনেকগুলো ডাইভারশন করেছি এবং এগুলো ফাংশনাল হয়েছে। ফলে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, বিজয় সরণিতে ইতিমধ্যেই ফাংশন হয়েছে। কাওরান বাজারে আমরা নতুন ইউটার্ন করেছি। এখানে আগে রাস্তার মাঝখানে অনেক বড় একটি ওয়াকওয়ে ছিল, আমরা সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ এখানে রাতের বেলায় ট্রাকগুলো এসে দাঁড়াতো। ফলে রাতের বেলায় জ্যাম থাকতো। এ সমস্যা সমাধান হয়েছে। গণপরিবহনের সমন্বিত উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের অধীনে একীভূত বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা আশাবাদী এতে ইতিবাচক ফলাফল আসবে।
নাগরিক সেবা পেতে মানুষের ভোগান্তি পোহানোর বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশাসক এজাজ বলেন, আগে কাউন্সিলর থাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই কাজগুলো হয়ে যেতো। কাউন্সিলররা নাগরিক সেবা, সমস্যা এবং ড্রেনেজ নষ্ট হয়ে গেলে এগুলো নিয়ে কাজ করতেন। এখন সব দায়িত্ব আমাদের ঘাড়ে এসেছে। এজন্য আঞ্চলিক অফিসগুলোতে আলাদা রুম করে দিয়েছি এবং গণশুনানির মাধ্যমে নাগরিকদের কাছ থেকে সরাসরি সমস্যা শুনে সমাধান করছি।
জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের কাজ কীভাবে চলছে জানতে চাইলে
তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধি না থাকায় আমাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে, এজন্য আমি প্রতিটি জোনে গণশুনানি করেছি। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের সমস্যাগুলো আমাদের জানাতে পেরেছে। অতীতে কেউ নগর প্রশাসনের কাছে তাদের সমস্যাগুলো সরাসরি বলতে পারতো না। আমরা সমস্যাগুলো নোট করে সমাধানের পরিকল্পনা সমন্বয় করেছি।
ভবিষ্যৎ সিটি করপোরেশনের জন্য কোনো পরিকল্পনা রেখে যাবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ৬ মাসে আমরা অনেকগুলো কাজ করেছি। আমার লক্ষ্য হচ্ছে আগামী ৬ মাসে এ কাজগুলোকে স্থায়ী করা। ১৮টি ওয়ার্ডের জন্য ইতিমধ্যে একশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে, বাকি ৩৬টি ওয়ার্ডের কাজ চলমান। মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে যাচ্ছি যেন ভবিষ্যৎ মেয়ররা এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেন। একশন প্ল্যানে কোনো ওয়ার্ডের পার্ক, ওয়ার্ড অফিস, স্কুল, কলেজ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র হবে তা নির্ধারণ করা হবে। যার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করা যাবে। সেগুলো আমি করে দিয়ে যাবো।
বিগত মেয়রদের অসমাপ্ত বড় প্রজেক্টগুলোর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু সড়ক এবং মহাসড়কের কাজ চলমান রয়েছে। তবে বিগত সময়ে মেয়ররা কোনো মাস্টারপ্ল্যান করেননি। আমরা প্রথমবারের মতো তা তৈরি করছি।
দখল হওয়া পার্ক পুনরুদ্ধারের বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু ক্লাব কর্তৃক দখল হওয়া পার্ক পুনরুদ্ধার করে স্থানীয় কমিউনিটির হাতে তুলে দিয়েছি। এগুলো করতে প্রচুর বাধার সম্মুখীন হয়েছি। কিছু ক্ষেত্রে আলোচনায়, আবার কোথাও উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছে।