Image description

গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও পরিবর্তন হয়নি রাজধানীর চাঁদাবাজির চিত্র। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও দেদারছে চলছে চাঁদাবাজি। ফুটপাথ থেকে টংদোকান, রাস্তা-ঘাট, অলিগলি সব জায়গা থেকে তোলা হয় কোটি কোটি টাকার চাঁদা। শুধু রাজধানীর তিন টার্মিনাল- গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ থেকে দিনে কোটি টাকার ওপরে চাঁদা তোলা হয়। সিটি করপোরেশন, টার্মিনাল ফি, শ্রমিক নেতা, পুলিশ, রোড খরচসহ বিভিন্ন নামে এই চাঁদা তোলেন রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। এর ভাগ পান প্রশাসনের কর্তারাও। তাই প্রশাসনের নাকের ডগার সামনেই চাঁদা তোলেন তারা। দেখেও না দেখার ভান করেন প্রশাসনের কর্তারা।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে জমা দেয়া একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, সিটি করপোরেশন, টার্মিনাল কর্তৃপক্ষের ফি, কাউন্টার ও টার্মিনালের খরচ, শ্রমিক, লাইনম্যান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং নিরাপত্তারক্ষীদের ফি আদায়ের নামে মোট ১১ ধরনের চাঁদাবাজি হচ্ছে। শুধু গাবতলীর ২৪০টি, সায়েদাবাদের ১০৮টি এবং মহাখালীর ৮৮টি সহ  প্রধান  তিনটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের টিকিট কাউন্টার থেকেই  প্রতিদিন ১ কোটি ৭ লাখ টাকা চাঁদার টাকা আদায় করা হচ্ছে। এছাড়াও স্থানীয় এবং আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ড থেকে ৮০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। শুধু দূরপাল্লার ও মাঝারি পাল্লার বাস নয়  ট্রাক, পিকআপ এবং কাভার্ড ভ্যান, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, হিউম্যান হলার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা এমনকি রিকশা থেকেও এসব টার্মিনাল থেকে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ, হিউম্যান হলার (লেগুনা) এবং অটোরিকশাসহ ৬৬টি টার্মিনাল এবং স্ট্যান্ডই রয়েছে রাজধানীতে। এর মধ্যে রয়েছে ৩৭টি লেগুনা স্ট্যান্ড, ৭টি স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড, ৫টি পিকআপ স্ট্যান্ড, ৪টি স্থানীয় এবং আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ড, ৪টি অটোরিকশা স্ট্যান্ড, ৩টি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল, ৩টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড, ২টি ট্রাকস্ট্যান্ড এবং ১ট মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড। এ সবের বেশির ভাগেই রমরমা চাঁদাবাজি চলছে। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলটির নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজির জন্য একটা টোকেন ব্যবহার করতেন। তবে এটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ চাঁদাবাজির চিহ্ন রয়ে যেত কাগজে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই ব্যবস্থার দখল নিয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। তারা ধরা পড়ার ঝুঁকি এড়াতে নৈশপ্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও লাইনম্যানদের বেতন পরিশোধের অজুহাতে এখন অভিনব কায়দায় চাঁদাবাজি করছেন। নগদ অর্থের পাশাপশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও এই টাকা লেনদেন হচ্ছে।

সরজমিন গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, সিডিউল অনুযায়ী ২৪০টি টিকিট কাউন্টার থেকে একের পর এক বাস যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে ছুটছে। আর বাসগুলো গাবতলী ব্রিজ ওঠার আগেই প্রত্যেক বাস থেকে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। চলন্ত বাসের দরজা থেকেই হাত বাড়িয়ে টাকা দিচ্ছে বাসের হেলপার-কন্ডাক্টররা। সিডিউল করে দিনে-রাতে এই চাঁদা উঠানোর জন্য নিয়োগ করা হয়েছে আলাদা লোক। টার্মিনালের অদূরে গাবতলী ব্রিজে ওঠার আগে গাবতলী-সদরঘাট বাইপাস সড়কের মোড়ে পুলিশ বক্সের দেয়াল ঘেঁষেই তাদের থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছে টিনের ঘর। সেখানে বসেই চাঁদা তুলছেন লাইনম্যানরা। কয়েকজন লাইনম্যান জানান, তারা বাস কোম্পানির লোক। প্রতিটি বাস থেকে তারা কোম্পানির ধার্য করা টাকাই উঠাচ্ছেন। তারা সবাই বেতনভুক্ত। তবে বেতন নির্ধারিত নয়, গাড়িপ্রতি। সার্জেট গাড়ি আটক করা থেকে শুরু করে গাড়ি এক্সিডেন্টসহ কোম্পানির সবধরনের ঝামেলাই মীমাংসা করে দেন তারা। তারা আরও জানান, গাবতলী এলাকায় কোথাও যদি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় তখন কোম্পানিকে খবর দেন তারা। তবে রহমত নামে বাসের এক হেলপার বলেন, গাবতলী থেকে ছাড়ার পর নবীনগর, সাভার, সব জায়গাতেই টাকা দিতে হয়। ৭০০-৮০০ লাগে প্রতি ট্রিপে। আবার জিপি দেয়া লাগে কারোর ৫০ টাকা, কারও আবার ৬০ টাকা। সিটি করপোরেশনের টাকা। সিরিয়ালের জন্য টাকা। এছাড়াও সাভার, চন্দ্রা, গাজীপুর মালিক সমিতিকে, টিআই এবং সার্জেন্টকে মাসিক ভিত্তিতে বা দৈনিক ভিত্তিতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা দিতে হয়। সব মিলিয়ে গাবতলী থেকে মাানিকগঞ্জ পর্যন্ত একটি গাড়িতে বিভিন্ন পয়েন্টে মোট হাজারখানেক টাকা চাঁদা দিতে হয়। মিজান নামে আরেক হেলপার বলেন, আমাদেরকে দিনপ্রতি ১ হাজার ১৫শ’ টাকা খরচ দিতে হয়। এই টাকা কিন্তু একজনকে নয়, বিভিন্ন জায়গা মিলে দিতে হয়। এই টাকাও কোম্পানির গাড়ির ট্রিপের খরচের সঙ্গে যোগ হয়। ধামরাই টু নারায়ণগঞ্জ চলাচলকারী সুমাইয়া পরিবহনের হেলপার বলেন, গাড়ি প্রথম স্টপেজ থেকে লাস্ট স্টপেজ পর্যন্ত পুরো রাস্তাতেই মোড়ে মোড়ে চাঁদা দেয়া লাগে। জিপিটিপি দিয়ে ১৪/১৫শ’ টাকা খরচ যায় গাড়িপ্রতি। এরপর মহাজনের জমার টাকা। এসব খরচ দিয়ে আমাদের হাতে আর তেমন কোনো টাকাই থাকে না। আমরা খুবই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি। আমাদের খবর কেউ রাখে না।  একটি দূরপাল্লার পরিবহনের সুপারভাইজার মো. সিরাজ বলেন, এই গাবতলী থেকে একটা গাড়ি রাজশাহী পর্যন্ত ২ হাজার থেকে ২৫শ’ টাকা পর্যন্ত শুধু চাঁদা দিতে হয়। মালিক সমিতির টাকা আলাদা। এরপরও আরও খরচ আছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন ব্যবসায়ী বলেন, এখন আগের চেয়ে কয়েকগুণ গাড়ি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে আমাদের গাড়িপ্রতি যাত্রীর সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। ব্যবসাও ভালো না। এরপরও চাঁদার পরিমাণ কমছে না। আগের চেয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে চাঁদার টাকা আরও বেড়েছে। আর এই চাঁদা কখনোই বন্ধ হবে না। আগে এক দলের লোকেরা নিতো, আর এখন আরেক দলের লোকেরা নিচ্ছে। কয়েকদিন আগে তো চাঁদার টাকা না দেয়ায় এরশাদ নামে এক গাড়ির মালিকের গাড়ি আটকে রেখেছিল স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। শুধুমাত্র ঢাকা থেকে বের হতেই টাকা দিতে হয় না, গাবতলী হয়ে ঢাকায় গাড়ি নিয়ে ঢুকতে গেলেও গাড়িপ্রতি ৭০০/৮০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ঢাকার বাইরে থেকে গাবতলী হয়ে বা গাবতলী থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকার মধ্যে ঢোকা প্রতিটি গাড়ি থেকে সিটি করপোরেশনের স্লিপ দিয়ে গাড়িপ্রতি নেয়া হয় ৪০ টাকা। গাবতলী বালুর মাঠের পাশে মসজিদের সামনে বেঞ্চে বসে ৫/৭ জন লোক হাতে স্লিপ নিয়ে দিনে-রাতে প্রতিটি গাড়ি থেকেই চাঁদা উঠাচ্ছেন। তবে এই টাকার বিনিময়ে সিটি করপোরেশন গাড়িগুলোকে ঠিক কী সেবা দেয় বা সিটি করপোরেশন এই চাঁদার টাকা পায় কি-না তার জবাব দিতে পারেননি তারা। তারা বলেন, আমরা বেতনভুক্ত। গাড়িপ্রতি আমরা কমিশন পাই। আমাদের স্লিপ দিয়েছে, আমরা টাকা তুলছি। এর বাইরে বেশি কিছু বলতে পারবো না। শুধু বাস নয়, গাবতলীতে যাত্রী নিয়ে ঢোকা ও যাত্রী উঠিয়ে গাবতলী এলাকা ছেড়ে আসা প্রতিটি সিএনজিচালককেও দিতে হয় চাঁদা। রহমতউল্লাহ নামে এক সিএনজিচালক বলেন, ঢাকায় প্রায় ৪০ হাজার সিএনজি চলে। আমরা এখান থেকে কোনো যাত্রী নিয়ে বের হলেই গাড়ি প্রতি ২০/৩০ টাকা দিতে হয়। ট্রাফিক পুলিশও এদের সঙ্গে। টাকা ছাড়া কেউ এখান থেকে যেতে পারে না।  

এদিকে মহাখালী টার্মিনালেরও একই অবস্থা। রাজধানী থেকে উত্তরবঙ্গ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন শতশত দূরপাল্লার বাস যাতায়াত করে। টার্মিনালটিতে নিয়মিত গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করা মনসুর নামে এক চালক বলেন, প্রতিদিন এই টার্মিনালে প্রায় ৮শ’ বাস প্রবেশ করে, ৮শ’ বাস বের হয়। সব বাসকেই টার্মিনাল ছাড়ার সময় ছাড়পত্র হিসাবে ৫২০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। আবার সিরিয়ালের জন্য গুনতে হয় ২০০/৩০০ টাকা। এরপরও সিটি করপোরেশন, শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন নামে গুনতে হয় আরও টাকা। রাস্তার খরচ উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি বাস মহাখালী থেকে  গন্তব্যে পৌঁছাতে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এই টাকা যেতেও দিতে হয়, আসতেও দিতে হয়। এই চাঁদার টাকা কেউ দিতে না চাইলেই তার গাড়ি সার্জেন্টকে দিয়ে আটক করানো হয়। তখন টাকার পরিমাণ আরও বেশি লাগে। লিয়াকত নামে এক সিএনজিচালক বলেন, কোনো সিএনজিচালক যদি এই টার্মিনাল থেকে যাত্রী উঠায় তাহলেই তাকে চাঁদা দিতে হয়। সিটি করপোরেশনের স্ল্লিপ ধরিয়ে দেয়। সিটি সার্ভিসের বাসগুলো থেকেও ঠিক একইভাবে চাঁদা নেয়া হয়। 

ওদিকে একই চিত্র সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালেও। প্রতিটি বাস ছাড়ার সময়ে গাড়িপ্রতি ৫০০-৭০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ওই চাঁদা উত্তোলন করা হয় মালিক সমিতির স্লিপে। চোখ ফাঁকি দিতে রশিদে টাকার পরিমাণ লেখা হয় না, তবে নাম ও বাস নম্বর লেখা থাকে রশিদে। আর প্রতিটি গাড়ির সিরিয়ালে ছাড়ার জন্য বাসমালিক সমিতিকে পরিবহন ‘ছাড়পত্র’ বাবদ দিতে হয়  ২০০-৩০০ টাকা চাঁদা। এছাড়াও সিটি করপোরেশনকে ইজারা ভিত্তিতে দৈনিক বাসপ্রতি ৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি বলছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ কর্মকর্তা, পরিবহন সমিতি, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা,  এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কর্তা-ব্যক্তি সকলেই এই চাঁদাবাজির টাকার ভাগ নেন। আর এসব নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আলাদা লাইনম্যান। 

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বর্তমানে পরিবহন খাত চাঁদাবাজি থেকে মুক্ত। ৫ই আগস্টের পর মালিক ও শ্রমিক সমিতির সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র সিটি করপোরেশনগুলো টোল আদায় করছে। আর যদি কারোর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আসে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, সরকার পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। আমরা যখনই অভিযোগ পাচ্ছি তখনই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। বিআরটিএও ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছে। এই খাতের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবো।