
কবর থেকে মৃতদেহ তুলে এনে রাস্তায় ফেলে আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। চারপাশ ঘিরে সেই দৃশ্য দেখছে একদল মানুষ, উল্লাসও করছে কেউ কেউ।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে দৃশ্য বাংলাদেশে কল্পনাও করা যেত না, গত পাঁচই সেপ্টেম্বর তেমনটাই ঘটেছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায়।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে 'তৌহিদি জনতা' পরিচয়ে একদল ব্যক্তি সংঘবদ্ধ হয়ে নুরুল হক, যিনি 'নুরাল পাগলা' নামেও পরিচিত, তার কবর, বসতঘর ও দরবারে হামলা চালায়।
হামলার এই ঘটনাটি হঠাৎ ঘটেনি, বরং "পরিকল্পিতভাবে" ঘটানো হয়েছে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
"ঘটনাটি একদিনে ঘটেনি। কয়েকদিন ধরে দু-পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলছিলো এবং স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারাও সেটা জানতেন," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান।
অভিযোগ রয়েছে, হামলার আগে স্থানীয় প্রশাসনের সামনেই এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চালানো হয় প্রচারণা। সাধারণ মুসল্লিদের ক্ষেপিয়ে তুলে তৈরি করা হয় মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা।
যদিও মব সৃষ্টি করে হামলার এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়। অর্ন্তবর্তী সরকারের গত এক বছরে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর এ ধরনের একের পর এক হামলা হতে দেখা গেছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের হিসেবে, গত বছরের অগাস্ট মাস থেকে চলতি বছরের অগাস্ট পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩৯০টি মবের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ১৯২ জন মানু্ষ প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও কমপক্ষে ৩৭৬ জন।
কিন্তু বেশিরভাগ ঘটনার ক্ষেত্রেই হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করতে দেখা যায়নি। হাতে গোনা যে কয়েকটি ঘটনায় কিছু ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে, তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি দিতেও দেখা যায়নি।
"বরং আমরা উল্টোটাই ঘটতে দেখছি। যাদের ওপর মব আক্রমণ চালিয়েছে, পুলিশ গিয়ে তাদেরকেই গ্রেফতার করছে। এতে করে যারা মব করছেন, তাদের সাহস আরও বেড়ে যাওয়ায় মবের ঘটনা বাড়ছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

ছবির উৎস,MITHUN GOSWAMI
নিন্দা জানিয়ে দায় সারছে সরকার?
মবের ঘটনায় সরকার কেবল নিন্দা ও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়ে দায় সারছে বলেও সমালোচনা রয়েছে।
যদিও অন্তর্বতী সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে, মবের বিরুদ্ধে তারা 'জিরো টলারেন্স' নীতি ঘোষণা করেছেন।
সরকারের আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটির সদস্য এবং উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনীকেও বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে মাঠে রাখা হয়েছে।
কিন্তু এক বছর ধরে চেষ্টার পরও অর্ন্তবর্তী সরকার কেন মবের মতো ঘটনা বন্ধ করতে পারছে না?
"এর দু'টি কারণ হতে পারে। হয় তারা চায় না এটা বন্ধ হোক, অথবা প্রশাসনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই বা তারা জানেই না কীভাবে মব বন্ধ করতে হয়," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পারছেন, সেটি নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন তুলতে দেখা যাচ্ছে।
তার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ-আন্দোলনও হতে দেখা গেছে। কিন্তু তারপরও তাকে স্বপদে বহাল রাখাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন কেউ কেউ।
"দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে উপদেষ্টাদের বিভিন্ন জন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান অভিযোগ থাকার পরেও সরকার তাদেরকে পরিবর্তন করেননি বা করার চেষ্টাও করেননি," বলেন অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।
"ড. ইউনূস তাদেরকে নিয়োগ দিয়েছেন? নাকি তিনি অন্য কাউকে খুশি করার জন্য এই উপদেষ্টাদের কাউকেই পদচ্যুত করতে পারার কোনো সক্ষমতা আমরা তার মধ্যে দেখি নাই," বিবিবি বাংলাকে বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আহমেদ।

মব যখন 'স্বার্থ হাসিলের অস্ত্র'
বেশিরভাগ মবের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। বরং তাদেরকে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে যখন 'নুরাল পাগলার মাজারে' হামলা হয়, তখনও পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু হামলা ঠেকাতে পারেননি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা এবং মবের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির নজির স্থাপন করতে না পারার কারণে ব্যক্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোষ্ঠী, সবাই মব তৈরির মাধ্যমে যে যার স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
এর ফলে দেশে অস্থিরতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
"একটা মব সৃষ্টি করে যখন মানুষকে নাজেহাল করা যায়, মানুষকে মেরে ফেলা যায়, মানুষের লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলা যায়; তখন এই ভীতি সঞ্চার করে সমাজের মধ্যে অনেক মানুষ নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য মবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান।
এমনকি রাজনৈতিক অনেক দল এবং গোষ্ঠীও মবকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
"বিশেষ করে যেসমস্ত দল বলছে যে, দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই; তারাই দেখা যাচ্ছে যে মব সন্ত্রাস বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে জড়িত," বিবিসি বাংলাকে বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
অপরাধ দমনে সরকারের নমনীয়ভাব পরিস্থিতিকে আরও অনিয়ন্ত্রিত করে তুলছে বলেও মনে করেন তিনি।
"সরকারের কর্মকর্তারা যখন মবকে প্রেসার গ্রুপ বলেন, যখন মব সৃষ্টিকারীদের গ্রেফতার না করে মবের শিকার ব্যক্তিদের গ্রেফতার করেন, তখন আসলে মব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের আরও আস্কারা দেওয়া হয়," বলছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ।

সীমাবদ্ধতা কোথায়?
ক্ষমতা গ্রহণের পর মব সহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকে ঘিরেই বেশি সমালোচনা ও প্রশ্নের সম্মুখিন হতে দেখা গেছে অন্তর্বতী সরকারকে।
জবাবে সরকার কেবল হামলার ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েই দায় সারছে বলে সমালোচনা করছেন অনেকে।
"মব বন্ধ করার জন্য যে ধরনের সদিচ্ছা থাকা দরকার, সেটাই আমরা সরকারের কর্মকাণ্ডে দেখছে পাচ্ছি না," বলছিলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
যদিও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন সময় তার ভাষণে বলছেন যে, মবের বিরুদ্ধে তার সরকারের 'জিরো টলারেন্স' নীতি রয়েছে।
"কিন্তু মব আক্রমণকারীদের গ্রেফতার না করে পুলিশকে আমরা উল্টো ভুক্তভোগীকে ধরে নিয়ে যেতে দেখছি। এর মানে কী? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশকে কী নির্দেশ দিয়েছে? যারা আক্রমণ করবে, তারা তোমার বন্ধু," বিবিসি বাংলাকে বলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ।
কিন্তু সরকারের কথা ও কাজের এমন "দ্বিমুখী আচরণের" কারণ কী?
"এই সরকারের ভেতরে আরও অনেক সরকার আছে। কতগুলো সরকার যে আছে, তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য না," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মানবাধিকারকর্মী সাইদুর রহমান।
সরকারের মধ্যে একাধিক "ভরকেন্দ্র" থাকার কারণে অনেক সময় শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকর করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।
"আমার মনে হয়, অধ্যাপক ইউনূস যে টিমের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন, তখন তিনি হরহামেশাই ভুলে যান যে, তার সেই টিমের ভেতর বহু মত, বহু পথের লোক আছে। তারা যে নিজ নিজ মত ও পথের লোকদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন, সেটা তার না বোঝার কথা নয়," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অধ্যাপক আহমেদ।

ছবির উৎস,BD MINISTRY OF HOME AFFAIRS
সরকার কী বলছে?
দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও সরকার অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে।
"স্বাভাবিক সময়ের সঙ্গে এখনকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তুলনা করাটা ঠিক হবে না। কারণ বর্তমানে একটা পোস্ট রেভ্যুলেশন সময়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অন্তর্বতী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
মি. ভূঁইয়া সরকারের আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটিরও সদস্য। তিনি দাবি করেছেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় হিসেবে বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা "যথেষ্ঠ ভালো" আছে।
"একটা রেভ্যুলেশনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যা দাঁড়ায়, সেই অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ঠ আছে," বলেন মি. ভূঁইয়া।
তাহলে একের পর এক মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটছে কেন?- প্রশ্ন ছিল সরকারের এই উপদেষ্টার কাছে।
"কিছু ঘটনা যে ঘটছে, সেটা আমরা অস্বীকার করছি না," জবাবে বলেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা মি. ভূঁইয়া।
কেন সেগুলো ঠেকানো যাচ্ছে না, সেটার একটা ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, "জুলাই বিপ্লবের পর স্থানীয় (প্রশাসনের) কাঠামো গুলো এক ধরনের ভেঙে পড়েছে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন না হওয়ার ফলে স্থানীয় সরকারেও জনপ্রতিনিধিরা নেই।"
"ফলে সবকিছু এক জায়গা থেকে দেখতে হচ্ছে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই আগের তুলনায় আইনশৃঙ্খলায় পরিস্থিতি উন্নতি ঘটছে না," বলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে সরকারের তরফে চেষ্টার ত্রুটি নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
"কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের পুলিশ বাহিনী যেভাবে ভেঙে পড়েছিল, সেটি এখনও পুরোপুরি দাঁড়াতে পারেনি। নৈতিকভাবে তারা এখনও দুর্বল জায়গায় রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে," বলেন মি. ভূঁইয়া।
মব সহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, "আইনের ক্ষেত্রে নানান সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হলেও সেগুলো এখনও কার্যকর করা যায়নি। ফলে আগের প্রচলিত আইনের অধীনেই বিচার কাজ চলছে। ফলে আসামিদের অনেকে জামিন পেয়ে যাচ্ছেন।"
"তবে তাদের যেন শাস্তির আওতায় আনা যায়, সেই চেষ্টা আমাদের রয়েছে। জনগণের জান-মালের ক্ষতি যেন কেউ না করতে পারে, সেজন্য আমরা প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিচ্ছি," বলেন মি. ভূঁইয়া।
অন্তর্বতী সরকারের পক্ষ থেকে এমন অভয় দেওয়া হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা নেওয়ার পর বছর পেরিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে ভয় ও শঙ্কা রয়েই গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।