
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ আজ মঙ্গলবার। ভোটের আগের দিন নিজের কার্যালয়ে নির্বাচনের নানা বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ ও মেহেদী হাসান।
ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেটা ছিল বিতর্কিত। এর আগে নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এবারের নির্বাচনটি ঐতিহাসিক। এই নির্বাচন আয়োজন করতে গিয়ে কী অভিজ্ঞতা হলো?
নিয়াজ আহমেদ খান: নির্বাচনটি প্রকৃত অর্থেই ঐতিহাসিক। স্বাধীনতার পরে এ ধরনের উদ্যোগ মাত্র আটবার নেওয়া হয়েছে। অতীতে বেশির ভাগ সময় প্রশাসন ওই পথে হাঁটেনি। আমরা ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করলাম মূলত তিনটি কারণে।
প্রথমত, এটি প্রকৃত অর্থেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি। তাঁদের মধ্যে উৎসাহ–উদ্দীপনা ব্যাপক। সারা দেশের মানুষও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক মূল্যবোধ হলো মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চর্চা।
আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই গণতন্ত্রের চর্চাকে এগিয়ে নিতে চেয়েছি। তৃতীয় কারণ, নানা রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভালো ঐতিহ্য রেখে যেতে চাই।
ডাকসু নির্বাচন আয়োজনে আমরা ১১ মাস ধরে ব্যাপক পরিশ্রম করেছি। অংশীজনদের সঙ্গে বহু বৈঠক করেছি। সব মিলিয়ে আমাদের একটি ভালো প্রস্তুতি আছে। কিছু আশঙ্কাও আছে।
আশঙ্কার বিষয়ে আমি পরে জানতে চাইব। আগে জানতে চাই, উদ্যোগটি আপনার, নাকি শিক্ষার্থীদের চাওয়ার কারণে; নাকি সরকারের পক্ষ থেকে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে বলা হয়েছে?
নিয়াজ আহমেদ: মোটিভেশন (অনুপ্রেরণা) মূলত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এসেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর হলে হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের মূল দাবির একটি ছিল ডাকসু নির্বাচন আয়োজন। এর বাইরে আমরা মনে করি, এটি গণ-অভ্যুত্থানের প্রতি একরকম সম্মান জানানোর সুযোগ।
সরকারের ক্ষেত্রে আপনার প্রশ্নের জবাবে আমি পরিষ্কার করে বলি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন ছাড়া আমরা সরকারের কাছে ধরনা দিই না। পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলছি, সরকারি সহায়তা ছাড়া এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান চালানো কঠিন। ডাকসু নির্বাচন আয়োজনে আমরা সরকারের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি। কিন্তু আমি তাদের দ্বারা কোনোভাবেই প্রভাবিত নই।
আমি বিনীতভাবে দু-একটি উদাহরণ তুলে ধরব, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের স্মরণকালের ইতিহাসে হয়নি। এবার ভোট গ্রহণে ৮১০টি বুথ রাখা হয়েছে। সাধারণত বুথের সংখ্যা থাকে ৩০০ থেকে ৩৫০–এর মধ্যে। আমরা প্রথমবারের মতো সব বিতর্ক এড়াতে ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে নিয়ে এসেছি। অনেক সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা বসানো হয়েছে। ভোট গণনার সময় প্রার্থীদের প্রতিনিধিরা থাকবেন। নির্বাচন কমিশনের লোকজন থাকবেন। সাংবাদিকদেরও রাখা হবে।
আপনি একটু আগে আশঙ্কার কথা বলছিলেন। আপনার চোখে আশঙ্কা কী কী?
নিয়াজ আহমেদ: এ ধরনের একটি আয়োজনে তো আসলে ‘ফুল প্রুফ’ (কোনো ধরনের আশঙ্কাহীন) বলে কোনো কিছু নেই। এটা আপেক্ষিক বিষয়। এ মুহূর্তে বড় দাগে কোনো আশঙ্কা আমরা দেখছি না। কিন্তু এ ধরনের কাজে কিছু আনফরসিন ফ্যাক্টর (অনুমান করা যায় না) থাকে, যা সব সময় নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তবে ডাকসু নির্বাচনকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আনন্দঘন করার জন্য আমাদের সামনে যা কিছু আসছে, সেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছি।
আমি বিনীতভাবে দু-একটি উদাহরণ তুলে ধরব, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের স্মরণকালের ইতিহাসে হয়নি। এবার ভোট গ্রহণে ৮১০টি বুথ রাখা হয়েছে। সাধারণত বুথের সংখ্যা থাকে ৩০০ থেকে ৩৫০–এর মধ্যে। আমরা প্রথমবারের মতো সব বিতর্ক এড়াতে ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে নিয়ে এসেছি। অনেক সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা বসানো হয়েছে। ভোট গণনার সময় প্রার্থীদের প্রতিনিধিরা থাকবেন। নির্বাচন কমিশনের লোকজন থাকবেন। সাংবাদিকদেরও রাখা হবে। পাশাপাশি বাইরে ইলেকট্রনিক পর্দায় তা দেখানো হবে। নির্বাচন কমিশনে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য লোকদের নেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, তুলনামূলক বিবেচনায় আমাদের প্রস্তুতি ব্যাপক এবং বিস্তারিত।
ডাকসু নির্বাচন আয়োজনে নানা প্রতিকূলতা ছিল। সেসব কথা আমরা বলছি না। কারণ, তা অতিক্রম করে এ পর্যন্ত এসেছি। আমার শেষ কথা হলো, আমরা আল্লাহর নামে এগোচ্ছি। মানুষের শুভবুদ্ধির ওপরে আমরা এখনো বিশ্বাস রাখছি। শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সমর্থন এবং তার সঙ্গে এখন মনে হচ্ছে সারা দেশ আমাদের সঙ্গে আছে—এটিকে আমাদের জন্য বিরাট ভিত্তি হিসেবে ধরছি। শুধু দৈবের ওপর নির্ভর না করে আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে যা যা করা সম্ভব, তার প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছি।
প্রার্থীদের কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, ভোটের দিন ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (ভোটের ফল পাল্টে দিতে অপকৌশল) হতে পারে।
নিয়াজ আহমেদ: প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের লুকানোর মতো কিছু নেই। এ অভিযোগের উত্তরের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন সাংবাদিকেরা। তাঁদের চোখের সামনে সবকিছু হবে। আমরা সবাই আপনাদের ক্যামেরার অধীনে থাকব। এ পরিস্থিতিতে কেউ রিগিং (কারচুপি) করার সাহস করবে না। ভোট গণনার সময় প্রার্থীদের এজেন্টরা (প্রতিনিধি) থাকবেন। প্রার্থী মিশ্র, কেউ কোনো ছাত্রসংগঠনের সদস্য, কেউ কেউ স্বতন্ত্র। তাঁদের সবাইকে ম্যানেজ করে ভোট গণনায় কারচুপি করা অসম্ভব। পাশাপাশি শিক্ষকেরা থাকবেন। একটু দূরেই নির্বাচন কমিশনের লোকজন সশরীর থাকবেন। এর মধ্যে ম্যানিপুলেশনের (কারসাজি) আশঙ্কা আসলে খুবই কম। তারপরও প্রয়োজন হলে যেকোনো কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা, বাতিল করার পূর্ণ ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া আছে।
আমরা চাই, অভিভাবকেরা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করুক। আমরা সবাই মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি মাইলফলক তৈরি করতে চাই। জাতি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
নিরাপত্তা পরিস্থিতি কী? সেনাসদস্যদের নিয়োগের একটা কথা বলা হয়েছিল। তাঁরা তো আসবেন না।
নিয়াজ আহমেদ: প্রথম কথা হচ্ছে, সেনাবাহিনী মোতায়েনের আলোচনাটা মূলত এসেছিল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে প্রার্থী, সাংবাদিক ও হল প্রশাসনের একটি মতবিনিময় সভায়। তবে এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আসেনি। সেনাবাহিনীর তিনটি ক্যাম্প অনেক দিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে এবং তা নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। আমাদের যদি কোনো সহায়তা লাগে, তা সেনাবাহিনীর কাছে বলার মতো ব্যবস্থাপনা আমাদের নিয়মিত কাঠামোর মধ্যেই আছে। এর সঙ্গে ডাকসু নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমি এমন কোনো আশঙ্কা দেখছি না যে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়ার প্রয়োজন হবে।
সব ভোটার কি ভোট দিতে আসতে পারবেন? কাউকে কোনো ‘ট্যাগ’ দিয়ে মারধর করার ঘটনা ঘটবে না তো?
নিয়াজ আহমেদ: আমরা ১১ মাস উদয়াস্ত পরিশ্রম করলাম। আক্ষরিক অর্থেই আমাদের সহকর্মীদের অনেক বিনিদ্র রাত কেটেছে। এটা আমরা কেন করলাম? কারণ, আমাদের শিক্ষার্থীরা এটা চেয়েছেন। এটা তাঁদের অনুষ্ঠান। আমরা আয়োজনটা করে দিয়েছি। আমরা কাল (মঙ্গলবার ভোটের দিন) তাঁদের বরণ করে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। তাঁদের অনুষ্ঠানে তাঁদেরই আনন্দের সঙ্গে আসতে হবে। এর আগে অনেক জটিল পরিস্থিতি আমরা মোকাবিলা করে এখানে এসেছি। এখন তো বরং তুলনামূলকভাবে আমাদের ভালো সময়। এ সময় তো স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পথে কোনো বাধা নেই। আমরা চাই, অভিভাবকেরা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করুক। আমরা সবাই মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি মাইলফলক তৈরি করতে চাই। জাতি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাকে যদি ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞেস করেন, আমি বলব ডাকসু নির্বাচন আমাদের নিয়মিত ক্যালেন্ডারের অংশ হয়ে যাওয়া উচিত। এবং সেটি শুধু লিখে দেওয়ার ব্যাপার না। এ জন্যই ভেতর থেকে একটা ‘টেম্পো’ তৈরির কথা বলছি।
আমরা দেখছি, প্রার্থীরা অনেক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ভোটের পর সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য জয়ী প্রার্থীরা চাপ দেবেন আপনাকে। এক বছরে পূরণের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা বাস্তবসম্মত বলে আপনি মনে করেন?
নিয়াজ আহমেদ: প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতিতে কিছুটা আবেগ রয়েছে। দীর্ঘদিন পরে এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনের সময় আবেগের স্ফুরণ থাকাটা আমি খুব অপরাধ বলে মনে করছি না। প্রশাসন আর ডাকসুর বিপরীত কোনো কিছু না। সুতরাং আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করতে থাকব। বাস্তবানুগভাবে যত দূর করা সম্ভব, সেটা করব। আমরা তো বেশ কিছু কাজ এমনিতেই করছি। এখন আরও সহজ হবে। কারণ, আমি পরিষ্কারভাবে জানব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রতিনিধি কারা।
পদাধিকারবলে ডাকসুর সভাপতি হিসেবে উপাচার্যের ক্ষমতা কমানোর কথা ছিল। কমল না কেন?
নিয়াজ আহমেদ: কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। আমি এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের একক ক্ষমতা কমিয়ে ফেলার পক্ষে। সে জন্য দুটি জিনিস করেছি। এক. আমি সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম (জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনা দল) তৈরি করে সেটি সিন্ডিকেটে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছি। এই ফোরামটা আগে ছিল না। উপাচার্য এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে নিতে পারেন না। সুলতান সুলেমানের (ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান) মতো ক্ষমতা এখন আর উপাচার্যের নেই। দুই. উপাচার্যের আর্থিক ক্ষমতা কমানোর জন্য একটা প্রস্তাব ইতিমধ্যে তৈরি করা হয়েছে, যাতে তিনি এককভাবে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি আর্থিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না পারেন। কিছুদিনের মধ্যেই এটি সিন্ডিকেটে যাবে।
এখন আসেন ডাকসু প্রসঙ্গে। ইতিহাসে হয়নি, এ রকম দুটি ঘটনা ঘটেছে। এখন উপাচার্যের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করা যাবে। এবং সেই অভিযোগ সিন্ডিকেট শোনার পর তারা যদি মনে করে, এটি মামলাযোগ্য, তাহলে সেটা আদালতে নেওয়া যাবে। দুই. ডাকসু–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত উপাচার্য একা নিতে পারবেন না। সিন্ডিকেটের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। ফলে উপাচার্য যে ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন, এখন সেটা আর একক নেই।
ডাকসু নির্বাচন কি প্রতিবছর হবে?
নিয়াজ আহমেদ: আমরা এটাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে যেতে চাই, যাতে ভেতর থেকেই একটা ‘টেম্পো’ (গতি) আসে। আমাকে যদি ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞেস করেন, আমি বলব ডাকসু নির্বাচন আমাদের নিয়মিত ক্যালেন্ডারের অংশ হয়ে যাওয়া উচিত। এবং সেটি শুধু লিখে দেওয়ার ব্যাপার না। এ জন্যই ভেতর থেকে একটা ‘টেম্পো’ তৈরির কথা বলছি।
শুধু ‘টেম্পোর’ ওপর নির্ভর না করে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করা যায় কি?
নিয়াজ আহমেদ: আইনি বাধ্যবাধকতা তো আগে থেকেই রয়েছে। মানা হয়নি। এটা আসলে নির্ভর করে আপনার মানসিকতা আছে কি না, তার ওপর।
আপনাকে ধন্যবাদ।
নিয়াজ আহমেদ খান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।