
“আমরা এই মর্মে একমত যে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর যে সকল প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।”
জুলাই জাতীয় সনদের যে ‘চূড়ান্ত খসড়া’ রাজনৈতিক দলগুলোর সই নেবার জন্য পাঠানো হবে, তার অঙ্গীকারনামা শেষ হবে এরকম একটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে। দলগুলো স্বাক্ষর করে দিলেই শেষ হবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মূল কাজ।
কিন্তু সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ দলের সবগুলো এই সনদে সই করবে? যদি সবাই না করে, সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না তো?
যেসব সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার দলগুলো করবে, সেগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে? অধ্যাদেশ জারি করে কতগুলো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব?
আসছে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে কতগুলো সুপারিশের বাস্তবায়ন করা যাবে? নির্বাচনের পর নতুন সংসদের কাঁধে কতগুলো সুপারিশ বাস্তবায়নের ভার বর্তাবে?
তখন যদি সংসদ প্রয়োজনীয় সমর্থন না পায়, জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ কী হবে?
এরকম নানা প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রেখেই চূড়ান্ত রূপ পেতে যাচ্ছে জুলাই সনদ। ফলে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান রাষ্ট্র সংস্কারের যে দুর্লভ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল, তার কতটা কাজে লাগানো সম্ভব হবে, সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
ঐকমত্যের বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চেয়ে আসছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ কয়েকটি দল। সমন্বিত খসড়ায় জুলাই সনদকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবিধানের উপরে স্থান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ তারা সরকারের কাছে উপস্থাপন করবে। সনদ বাস্তবায়ন দায়িত্ব থাকবে সরকারের ওপর।
কথ ছিল, জুলাই জাতীয় সনদের ‘চূড়ান্ত খসড়া’ ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে সই নেবার জন্য। কিন্তু বৃহস্পতিবারে এসে সেই সময় আরো এক সপ্তাহ বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।
সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সাড়ে ছয় মাসের দীর্ঘ সংলাপের ভিত্তিতে এর আগে প্রাথমিক খসড়ার ওপর দলগুলোর মতামত নিয়ে ‘পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া’ তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে দলগুলো যে মতামত দিয়েছে, তার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে ‘চূড়ান্ত খসড়া’।
সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ঐকমত্য কমিশন সংশ্লিষ্টরা বহুল আলোচিত এ সনদে সই করবেন।
আলী রিয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পর্যালোচনার ভিত্তিতে এ সপ্তাহেই বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনায় বসবে কমিশন। এরপর চূড়ান্ত সনদ ও বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ বৃহস্পতিবারের মধ্যে একসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে।"
অধ্যাদেশ দিয়ে কতগুলো সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব
জুলাই জাতীয় সনদের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের একটি উপায় হল অধ্যাদেশ জারি করে আইনি ভিত্তি দেওয়া, যা কয়েকটি দল দীর্ঘদিন ধরে চেয়ে আসছে।
তবে রাজনীতি ও আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ কয়েকজন বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদের ভবিষ্যৎ একমাত্র জাতীয় সংসদ।
কোনো বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করলেও সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তা নতুন করে আইন আকারে পাস করতে হয়। না হলে তা কার্যকারিতা হারায়। এমনকি গণভোট করতে হলেও সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
সেক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারি করে সংবিধান পরিবর্তন সম্ভব হবে না। আর যেসব বিষয়ে এখন অধ্যাদেশ জারি করা সম্ভব, সেগুলোও পরে সংসদে পাস করাতে না পারলে বাতিল হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।
দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্ক শেষে রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক ১৯টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছানোর কথা বলেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে ১০টিতে বিভিন্ন দলের কাছ থেকে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) এসেছে। বাকি নয়টিতে ‘শতভাগ ঐকমত্য’ রয়েছে।
সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সংবিধানের যে কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারি করে আইনি ভিত্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে হাত দিতে হলে সংসদ লাগবে।
"যে নয়টি বিষয়ে শতভাগ ঐকমত্য হয়েছে, সেটা অধ্যাদেশ দিয়ে আইনি ভিত্তি দিতে পারে।"
ঠিক কতটি বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করা সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, "আমরা একটা সুপারিশ সরকারের কাছে পাঠাব, সেখান থেকে সরকার যেটা ভালো মনে করে করবে।
“নয়টি বিষয় না দশটি বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করবে, নাকি করবে না, অথবা কতগুলোতে করবে সেটা সরকারের বিষয়। আমরা ঠিক করে বলতে পারব না।"
সনদে সব দল স্বাক্ষর করবে?
কমিশন ৩০টি দলের কাছে মতামত চেয়েছিল। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ২৬টি দল মতামত জমা দেয়। গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি), রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোট মতামত দেয়নি।
বামগণতান্ত্রিক জোটের চার দল ছাড়াও গণফোরাম ও বাংলাদেশ জাসদ খসড়ার বেশ কিছু বিষয়ে আপত্তি তুলেছে।
সংলাপে যেসব বিষয়ে ‘পূর্ণাঙ্গ ঐকমত্য’ হয়েছে, কেবল সেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে অঙ্গীকারনামার ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর সই নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বাংলাদেশ জাসদ।
দলটি বলছে, জুলাই জাতীয় সনদকে ‘সংবিধানের ঊর্ধ্বে’ স্থান দেওয়া যাবে না। সনদ নিয়ে যদি কেউ সংক্ষুব্ধ হয়, তাকে আদালতের দ্বারস্থ হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
সংবিধানের সংশোধনীগুলো নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ও উচ্চকক্ষে (যদি নির্বাচিত হয়ে) গ্রহণ করার পক্ষে মত দিয়েছে দলটি।
সিপিবিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের চার দল ইতোমধ্যে সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন প্রশ্নে আপত্তি জানিয়েছে কমিশনে। দলগুলো বলছে, সংসদ ছাড়া সংবিধান সংস্কারের কোনো সুযোগ রাখা হলে তারা সনদে সই ‘নাও করতে পারে’।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটা হচ্ছে সনদ, আরেকটা হচ্ছে সনদের বাস্তবায়ন। তারা আমাদের কাছে জানতে চাইবেন এটার সঙ্গে আমরা থাকতে পারব কি না। আর আমরা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তর দিয়ে দেব।
“সনদ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের লিখিত মত তারা জানতে চান, কীভাবে বাস্তবায়ন করবে তা অন্যদের সাথে আলোচনা কর আমরা একটা মত দেব। এখানে থাকা বা স্বাক্ষর করা সম্ভব কি না তা চূড়ান্ত খসড়া দেখার পর আপনাদের জানিয়ে দেব।”
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “আমরা আগেও বলেছি এখনও বলছি, বর্তমান বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিলে এটা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না।”
গণফোরামরে সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানও সংবিধান সম্পর্কিত বিষয়গুলো, বিশেষ করে চার মূলনীতি পরিবর্তন করলে ‘স্বাক্ষর করা সম্ভব নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন।
বিএনপি জামায়াত ও এনসিপিসহ মোটামুটি ২০টি দল সনদে স্বাক্ষর করার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। বাকিদের মধ্যে রয়েছে অনিশ্চয়তার সুর।
‘শতভাগ ঐকমত্য’ নিয়ে দ্বন্দ্ব
রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে দীর্ঘ সাড়ে ছয় মাস ধরে চলা সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০টি রাজনৈতিক দলের সবাই যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, কেবল সেসব বিষয়েই ‘ঐকমত্য’ হয়েছে বলে মনে করছে কয়েকটি দল।
আর কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যে সব বিষয়ে একমত হয়েছে, তাকেই ‘ঐকমত্য’ হিসেবে গণ্য করা হবে।
এ বিষয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স বলেন, “গত বছরের ৫ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকের সময় বলেছেন, যে-সব বিষয়ে সকল দলের ঐকমত্য হবে, সেগুলোই জুলাই জাতীয় সনদে আসবে। কিন্তু এখন আমরা দেখলাম যেসব বিষয়ে অনেকে একমত হয়নি, সেসব বিষয়ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে খসড়ায় বলা হয়েছে।
“উনাদের সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব ঐকমত্য নিয়ে, কারণ যেসব বিষয়ে সবাই একমত, সেগুলোকে ‘ঐকমত্য’ বলতে পারবেন, অন্যগুলোকে ‘ঐকমত্য’ বলা উচিত না। কিন্তু আপনারা অন্যগুলোকে ‘ঐকমত্য’ বলে জটিলতা সৃষ্টি করছেন। এরকম থাকলে আমরা আগেও বলেছি, লিখিত দিয়েছি, হয়ত এই ঐকমত্যের পক্ষে থাকা সম্ভব হবে না।”
যেসব প্রস্তাবে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) আছে
• রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন: ভিন্ন জানিয়েছে বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও গণফোরাম।
• রাষ্ট্রপতির নির্বাচনপদ্ধতি: ভিন্নমত দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
• রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব: আংশিক ভিন্নমত আছে বিএনপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, লেবার পার্টি, এনডিএম, এলডিপি, ১২ দলীয় জোট ।
• প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার সুযোগ বিলোপ: বিএনপি, এনডিএম, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও ১২ দলীয় জোট ভিন্নমত দিয়েছে।
• তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা: কিছু অংশে ভিন্নমত দিয়েছে বিএনপি, লেবার পার্টি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২–দলীয় জোট।
• উচ্চকক্ষে নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি: ভিন্নমত দিয়েছে বিএনপি ও এনডিএম।
• উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ: ভিন্নমত দিয়েছে বিএনপি ও এনডিএম।
• উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা: সিপিবি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, এনডিএম, আম জনতার দল ভিন্নমত দিয়েছে।
• নারী আসনের বিধান: সিপিবি, বাসদ, আম জনতার দল ভিন্নমত জানিয়েছে।
• ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকারি কর্ম কমিশনে নিয়োগ, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগ: ভিন্নমত দিয়েছে বিএনপি, এনডিএম, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট।
বাস্তবায়ন নিয়ে যা বলছে কমিশন
জুলাই জাতীয় সনদের ভবিষ্যৎ কী এবং বাস্তবায়ন কীভাবে হবে জানতে চাইলে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সকল রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে।
“জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা সকল রাজনৈতিক দলের সাথে ইতোমধ্যে বসেছি। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির সাথে আমাদের কথা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে লিখিতভাবে জানাতে বলেছি, যেহেতু আপনাদের হাতে সনদ আছে, তাহলে বাস্তবায়নটা কীভাবে হবে সেটা আপনারা আমাদের বলুন।”
তিনি বলেন, “আমরা বিশেষজ্ঞদের সাথে বসেছি, তাদের কিছু প্রস্তাব আছে, সুপারিশ আছে প্রক্রিয়াগত। অ্যাটর্নি জেনারেলের সাথে কথা বলেছি, আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বসেছি। তাদের কিছু প্রস্তাব আছে, সুপারিশ আছে।
“তাদের বলেছি, আপনারা লিখিতভাবে দিন, সেগুলো নিয়ে আমরা বসব, এক বা একাধিক সুপারিশ সরকারকে দেব। এর আগে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বসব, বিশেষজ্ঞদের সাথে বসব।”
সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ দলের সবাই স্বাক্ষর না করলে, তাতে ঐকমত্য নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে কি না– সে বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, “যারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন, তারা দিয়েছেন। আমরা যখন আবার চূড়ান্তটা পাঠাব, তখন হয়ত অনেকে নোট অব ডিসেন্ট তুলে নিতে পারে।
“সকল দল একত্রিত হলেই কেবল ঐকমত্য হবে–এই ধারণাটার মধ্যে খানিকটা বিভ্রান্তি আছে। এখানে দুই পক্ষ হলে আপনি বলতে পারতেন। বাংলাদেশের ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে সংলাপে। সেই ক্ষেত্রে সকলেই সব বিষয়ে একমত হবে–এটা ধারা করার বিষয় না।”
তিনি বলেন, “এর পরেও কার্যত আটটি বিষয়ে আপত্তি আছে ২০টির মধ্যে। এর আগে ৬২টার মধ্যে অধিকাংশের ক্ষেত্রে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত। একটি বা দুটি দল কেবলমাত্র আপত্তি তোলার কারণে ঐকমত্য বাধাগ্রস্ত হয়ে যায় না।”
‘আইনি ভিত্তি’
সনদ স্বাক্ষরের পরে কোন প্রক্রিয়ায় বা কীসের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে নানা মত রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর। বিএনপি ও জামায়াতের দাবিতে সমন্বিত খসড়ায় এই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে সংবিধানের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলেও এ সনদের বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।
পাশাপাশি সনদের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা, কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
সনদের আইনি ভিত্তি দাবি করে আসা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “আমরা শুরু থেকেই ধরে নিয়েছিলাম, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো আইনগত ভিত্তি পাবে এবং তা বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক হবে। কিন্তু যদি আইনগত ভিত্তি না থাকে, তাহলে এটি কেবল কথার কথা থেকে যাবে–যা জনগণ মানবে না, গুরুত্ব দেবে না।"
তার ভাষ্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের পরিস্থিতি বহুবার তৈরি হয়েছে এবং তখনও আইনি জটিলতা পেরিয়ে সমাধানের পথ বের করা হয়েছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “জুলাই সনদকে যদি আমরা একটা আইনি ভিত্তির জায়গায় নিয়ে আসতে না পারি, সেক্ষেত্রে সেই জুলাই সনদ সেটা পূর্বেকার মত তিন দলের রূপরেখার (৯১ সালের ঘটনা) মত শুধু একটা ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে। যার কোনো কার্যকারিতার জায়গা থাকবে না। আমরা একটা অকার্যকর অপূর্ণাঙ্গ মৌলিক সংস্কারবিহীন জুলাই সনদ চাই না।
তবে বিএনপি বলে আসছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়নের জায়গা হবে আগামী জাতীয় সংসদ। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে পাঠানো তিন পৃষ্ঠার মতামতে দলটি বলেছে, অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা আইনি ও সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘অসম্ভব, অসংগত ও অগ্রহণযোগ্য’।
সংবিধানের অধীনে গঠিত কোনো সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে বিদ্যমান সংবিধানের জায়গায় নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে সেটি বিপ্লব নয়; বরং ‘ক্যু’ হিসেবে গণ্য হবে বলেও মত দিয়েছে বিএনপি।
বিশ্লেষকরা কী বলছেন
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদের বিকল্প দেখছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে পরবর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর, অর্থাৎ যারা নির্বাচিত হবে। আর পরবর্তী সরকার দুইভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেন, আইনি বাস্তবায়ন-একটা হল আইন তৈরি করা। আরেকটা হল আপনি সরাসরি বাস্তবায়ন করতে পারেন। সেটা করতে সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট লাগবে।
“যদি আপনি বর্তমান সংবিধানের অধীনে নেন, তাহলে আপনাকে অবশ্যই আগামী সংসদ পর্যন্ত অপেক্ষায় করতে হবে।”
অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সনদের বাস্তবায়ন প্রশ্নে অধ্যাপক মাহবুব বলেন, “এখন যদি সনদ নিয়ে অধ্যাদেশ জারি হয়, সেটাতে বলতে হবে এই সনদ আগামী সংসদ পাশ করবে।”
জুলাই সনদকে সামাজিক চুক্তি হিসেবে বর্ণনা করে মাহবুবুর রহমান বলেন, “এখন রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করল, এটা একটা সামাজিক সম্মতি তৈরি হল, সামাজিক চুক্তি হল–যে আমরা এটা মেনে নিয়েছি।
“এর মানে ঠিক সাংবিধানিক ভিত্তি না থাকলেও এক ধরনের প্রথা তৈরি হয়ে যায়। সামাজিক চুক্তি হয়ে যায়। সেই সামাজিক চুক্তিটাও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কম না।”
এখন অধ্যাদেশ জারি করা হলেও সামনে যে সংকট থেকেই যাবে, তা মনে করিয়ে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, “আইন তো সংসদ থেকেই পাস হয়। তাহলে সংসদের বাইরে কি আইনি ভিত্তি আছে?
“অধ্যাদেশ সংক্রান্ত আইনটা হল যে পরবর্তী সংসদে এটা উত্থাপন করতে হবে। সংসদে এটাকে বাতিল করতে পারে, বাতিল না করলে সংসদ অধিবেশনে ৩০ দিনের মাথায় অটোমেটিকলি বাতিল হয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, “জুলাই সনদকে কোনো ধরনের আইনগত ভিত্তি দিতে হলে এটা একমাত্র সংসদই পারবে। দ্বিতীয়ত অনেকে বলছে যে এটা সংবিধানের উপরে স্থান দিতে। সংবিধানের উপরে যদি আরেকটা আইন করা হয়, তাহলে তো আর সংবিধান সংবিধান থাকবে না। এগুলো হল আইনি জ্ঞান বিবর্তিত আলোচনা।”
গণভোট করারও সুযোগ নেই মন্তব্য করে মালিক বলেন, “এখন করতে হলে গণভোটের আইন করতে হবে। গণভোট কীভাবে হবে? কী কী বিষয়ে গণভোট হতে হবে–এটা লম্বা করে আইন করতে হবে। তারপর আমাদের দেশের জনগণ ভোট দেবে।
“এই সব বিষয় নিয়ে গণভোট করার কোনো সুযোগ সংবিধানে নেই। গণভোট করা যাবে কেবল মাত্র সংবিধানের প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮ আর ৫৬ বিষয়ে। এর বাইরে গণভোটও করতে পারবে না। চারটা অনুচ্ছেদের সংশোধনী করতে হলে গণভোটের কথা বলা আছে। এর বাইরে গণভোট করতে হলেও সংসদ লাগবে।”
তিনি বলেন, “মোট কথা, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে গেলে জাতীয় সংসদ ছাড়া কোনো উপায় নাই। এক কথায় জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ হচ্ছে সংসদ।”
সংসদ বিষয়ক গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন অধ্যাপক নাজিম উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্তমান সরকার শপথ গ্রহণ করছে যে, সংবিধান সংরক্ষণ করবে।
“সংবিধান যখন সংরক্ষণ করবেন, তাহলে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হলে আগামী সংসদ ছাড়া কোনো উপায় নাই।
“যেটা করতে পারেন, আপনি সর্বসম্মত ঐকমত্যে যেতে পারেন। এই ৩০টা দল যদি জাতিকে বলে, ‘আমরা এটা সই করলাম এবং আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনে আমরা সংবিধান সংশোধন করে আইন পাস করব’, এর থেকে বড় প্রতিশ্রুতি আর কি হতে পারে, যদি এটা ভাঙে, তাহলে তো আপনার রাষ্ট্রই থাকবে না।”
তিনি বলেন, সংবিধানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, অধ্যাদেশ দিয়ে কোনোভাবেই সংবিধান সংশোধন করা যাবে না।
“জিয়াউর রহমানের সময় সংবিধানে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, তখন তো সংবিধান ছিল না, সেই সরকার তো সংবিধানের মেনে হয় নাই। তখন রাষ্ট্রে কোনো আইন ছিল না। ওটা জংলি আইন, জংলি আইনের রেফারেন্স সাংবিধানিক সরকারের এখানে এনে কোনো লাভ হবে না।
“গণভোটে কিছু করতে হলে এতগুলো মানুষকে বোঝতে হবে, তো ৮৬টা প্রস্তাব জনগণ পড়ে পরে ভোট দেবে? সংবিধানের বাইরে সরকারে যাওয়ার কোনো রাস্তা নাই।”
অধ্যাপক নাজিম বলেন, “সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করতে হলে সংবিধান মেনে শপথ নিলেন কেন? আপনারা বিপ্লবী সরকার গঠন করতেন, তাহলে তো অনেক কিছুই করতে পারতেন। এখন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হলে আগামী সংসদ অপেক্ষা করতে হবে।”