Image description

অস্ট্রেলিয়ায় বিষাক্ত ডেথ ক্যাপ মাশরুম খাইয়ে তিনজনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এরিন প্যাটারসনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে মেলবোর্নের সুপ্রিম কোর্ট। এই রায়ে বলা হয়েছে, সাজা চলাকালীন ৩৩ বছর পর্যন্ত তিনি প্যারোলের সুযোগ পাবেন না।

৫০ বছর বয়সী এরিন প্যাটারসন তার তিন জন আত্মীয়কে হত্যা এবং আরো একজনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।

দুই সন্তানের মা এরিন তার বাড়িতে বিফ ওয়েলিংটন নামে একটি খাবার রান্না করে অতিথিদের পরিবেশন করেছিলেন।

পরে দেখা যায় সেখানে ছিল বিষাক্ত ডেথ ক্যাপ মাশরুম। ঘটনাটি ঘটেছিলো দুই বছর আগে ২০২৩ সালের ২৯শে জুলাই দুপুরের খাবার বা লাঞ্চের টেবিলে।

সোমবার আদালতে শুনানি চলাকালে প্যাটারসন বেশিরভাগ সময় চোখ বন্ধ রেখেছিলেন। শুধুমাত্র রায় যখন ঘোষণা করা হয় তখন চোখ খুলেছিলেন তিনি।

তবে রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণার পর তিনি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি।

যেমন ছিল আদালতের পরিবেশ

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের রায় ঘিরে সোমবার মেলবোর্ন সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের ওই কক্ষটিতে অনেক ভিড় লক্ষ করা গেছে।

গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য রাখা বেঞ্চটি পরিপূর্ণ ছিল। আর সাধারণ মানুষদের জন্য বসার বেঞ্চগুলোতেও অনেক মানুষের ভিড় ছিল।

আদালতে রায় শুনতে যারা এসেছিলেন, তারাও তাকাচ্ছিলেন প্যাটারসনের দিকে। কাঠগড়ায় প্যাটারসনের মাথার উপরের অংশ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না।

আদালতে যখন রায় ঘোষণা করা হয়, তখন বেশিরভাগ সময় চোখ বন্ধ রেখেছিলেন এরিন প্যাটারসন। তার বিরুদ্ধে যখন পরিবারের সদস্যদের সাক্ষ্য পড়ে শুনানো হচ্ছিল তখনও তিনি ছিলেন নির্বিকার। রায় ঘোষণা শেষে যখন আদালতের কাঠগড়া ধীর পায়ে হেটে বের হচ্ছিলেন প্যাটারসন।

যখন বিচারক প্যাটারসনের অপরাধের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন তা নোট করছিলেন সাংবাদিকরা।

রায় ঘোষণার সময় বিচারপতি মিজ প্যাটারসনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "আপনি আপনার দোষ আড়াল করার জন্য এক জটিল কৌশল নিয়েছিলেন এবং এটি ছিল ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা"।

বিচারপতি আরো বলেন, "এই হত্যাকাণ্ডটি ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। ঘটনাটিকে আড়াল করতে নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন প্যাটারসন। তিনি মিথ্যা বলেছিলেন, বিষাক্ত মাশরুম সংগ্রহ করার বিষয় অস্বীকার করেছিলেন, খাবারের প্লেট ফেলে দিয়েছিলেন এবং পুলিশের কাছে অনেক বিষয়ে মিথ্যা বলেছিলেন"।

আলোচিত সেই মাশরুম লাঞ্চের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একমাত্র অতিথি ইয়ান উইলকিনসন সোমবার আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের বলেন, তার আবেদন এইটুকুই সবাই যেন ঘটনাটিকে ঘিরে দয়া এবং সহমর্মিতা প্রদর্শন করে।

রায় শেষে গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাদীপক্ষ
ছবির ক্যাপশান,রায় শেষে গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাদীপক্ষ

বাকী জীবন থাকতে হবে জেলে

অনেকদিন ধরে জেলে আছেন এরিন প্যাটারসন। আদালতের রায় অনুযায়ী তার জীবনের বাকি সময় জেলে কাটাতে হবে।

তিনি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা সেলে কাটাচ্ছেন, খাবার ও ওষুধ দরজার ফাঁক দিয়ে দেওয়া হয়। ব্যায়াম ও একটু খোলা বাতাস নেওয়ার জন্য ছোট একটি কনক্রিটের মাঠও রয়েছে।

সেখান থেকে অন্য বন্দির সঙ্গে তারের বেড়ার ফাঁকা দিয়ে কথা বলার সুযোগ রয়েছে। সপ্তাহে দুই বার ২০ মিনিটের জন্য কারাগারের লাইব্রেরি ব্যবহার করা যায়।

রায়ে বলা হয়, আগে জাতিসংঘ নির্দেশনা মেনে কোনো বন্দিকে ১৫ দিনের বেশি আলাদা সেলে রাখা উচিত নয়। কিন্তু প্যাটারসন ইতিমধ্যেই ১৫ মাস ধরে এমন অবস্থায় ছিলেন।

বাদী পক্ষের আইনজীবীর দাবি, এরিন ইচ্ছাকৃতভাবে ওই বিষাক্ত মাশরুম খাবারে মিশিয়েছিলেন।

বাদীপক্ষ আদালতে তাদের আবেদনে প্যারোল ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আবেদন করেছিলেন।

কিন্তু শুনানি শেষে সোমবারের রায়ে আদালত যাবজ্জীবনের পাশাপাশি প্যারোলের সুযোগ রেখেছে। বলা হয়েছে এই প্যারোল তিনি পাবেন ৩৩ বছর পর।

রায় ঘোষণার সময় বিচারপতি মন্তব্য করেন, "আপনার নিরাপত্তার স্বার্থে আপনাকে হয়তো বছরের পর বছর একক সেলে রাখা হবে।"

বাদীপক্ষ থেকে আদালতে উপস্থিত ছিলেন এরিনেরই আত্নীয় ইয়ান উইলকিনসন। তিনি রায় ঘোষণার পর সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। একই সাথে তিনি তার পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষারও দাবি জানান।

উইলকিনসন পুলিশের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, "তিনজন ভালো মানুষের সঙ্গে কী ঘটেছিল, তার সত্য উন্মোচন করেছে পুলিশ।"

এরিন এই টেবিলে বিফ ওয়েলিংটন নামে একটি খাবার অতিথিদের পরিবেশন করেছিলেন।

ছবির উৎস,Supreme Court of Victoria

ছবির ক্যাপশান,এরিন এই টেবিলে বিফ ওয়েলিংটন নামে একটি খাবার অতিথিদের পরিবেশন করেছিলেন।

আলোচিত মাশরুম হত্যা মামলা

বাদী পক্ষের আইনজীবীর দাবি, এরিন ইচ্ছাকৃতভাবে ওই বিষাক্ত মাশরুম খাবারে মিশিয়েছিলেন।

এজন্য তিনি পাশের শহর থেকে আগে থেকেই বিষাক্ত ডেথ ক্যাপ মাশরুম সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি ক্যানসারে ভুগছেন এমন মিথ্যা কথা বলে আত্মীয়দের লাঞ্চে দাওয়াত করেন। পরে প্রমাণ লুকাতে পুলিশকে মিথ্যা বলেন এবং প্রমাণ সরিয়ে ফেলেন।

তবে বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর দাবি, তার মক্কেল মাশরুম খেতে ভালোবাসেন এবং তিনি বিভিন্ন ধরনের মাশরুম সংগ্রহ করেন। তিনি দুর্ঘটনাবশত এই বিষাক্ত মাশরুম খাবারে দিয়েছিলেন এবং পরে ভয় পেয়ে মিথ্যা বলেছেন কারণ প্রিয়জনদের এই করুন পরিণতি দেখে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেদিন যা কিছু ঘটেছে তা একটি দুঃখজনক দুর্ঘটনা মাত্র।

অভিযোগ দায়েরের সময় এরিন প্যাটারসন সাংবাদিকদের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন,"আমি এই ঘটনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমি তাদের ভালবাসতাম। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, তারা নেই।"

কিন্তু হত্যার কোনো কারণের কথা এখনো জানা যায়নি। বাদীপক্ষের আইনজীবীর দাবি কাউকে হত্যার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করতে কারণ বা উদ্দেশ্য লাগে না।

বিষাক্ত সেই মাশরুমগুলো তার বাড়ির কাছাকাছি একটি জায়গায় পাওয়া যায়। ফোনের রেকর্ডেও দেখা যায়, এরিনের মোবাইল সেই এলাকায় সচল ছিল।

এরিনের আইনজীবী স্বীকার করেছেন, এরিন সেই দিনগুলিতে পুলিশকে একাধিকবার মিথ্যা বলেছিলেন।

তার মধ্যে একটি মিথ্যা ছিল, তিনি বলেছিলেন, তিনি মাশরুম শুকাতে যে ডিহাইড্রেটর মেশিনটি ব্যবহার করেছিলেন, সেটা ফেলে দিয়েছেন, কিন্তু কোথায় ফেলেছেন তা লুকিয়েছিলেন।

পরে দেখা যায়, তিনি সেটি স্থানীয় একটি জায়গায় ফেলেন, আর সেটা সিসিটিভিতে ধরা পড়ে।

এরিনের শ্বশুর-শাশুড়ি, ডন ও গেইল সেদিন দুপুরে একটি কমলা ফলের কেক নিয়ে এসেছিলেন। এরিন তার প্রাক্তন স্বামী সাইমন প্যাটারসনকেও দাওয়াত করলে তিনি আগের দিনই সেখানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

দাম্পত্য জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তাদের মধ্যে টানাপড়েন থাকায় তিনি সেখানে যেতে "অস্বস্তি" বোধ করছিলেন।

সেদিন সকালে অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় এক রাঁধুনির রেসিপি অনুসরণ করে এরিন বেশ কষ্ট করে রান্নাবান্না করেন।

তিনি নিজের মতো করে রেসিপিতে কিছু পরিবর্তন করেন। মূলত বিফ ওয়েলিংটন খাবারটি একেকজন একেকভাবে রান্না করে থাকেন। এখানে মূলত স্টেকের টুকরোয় মাশরুম পেস্ট মেখে রান্না করা হয়।

বেঁচে ফেরা একমাত্র ব্যক্তি জুরিদের সামনে বলেন, তিনি দেখেছিলেন খাবারগুলো চারটি ছাই রঙের থালায় পরিবেশন করা হয়, আর এরিন তার খাবারটি একটি কমলা থালায় নিয়ে আসেন।

সঙ্গে ছিল ম্যাশড পটেটো, সবুজ মটরশুঁটি এবং ঘন ঝোল। আরেকটি প্লেট সাইমনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। যদি তিনি সিদ্ধান্ত বদলান। পরে সেই প্লেটটি ফ্রিজে রাখা হয়।

প্রথমদিকে এরিনের বিরুদ্ধে সাইমনকেও হত্যা চেষ্টার অভিযোগ তোলা হয়েছিলো। কিন্তু বিচার শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে এই অভিযোগ বাদ দেওয়া হয়।

এরপর সবাই একসাথে প্রার্থনা করে খাবার খেতে শুরু করেন। খাবার সময় তারা নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টাও করছিলেন।