Image description

গত শুক্রবার (৫ই সেপ্টেম্বর) রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার কবর, বাড়ি ও দরবার শরীফে হামলার ঘটনা ঘটে। এমনকী তার 
মরদেহ কবর থেকে তুলে মহাসড়কে নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়। আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ। বিভিন্ন অভিযোগ এনে মাজারে হামলা চালায় তৌহিদি জনতা। এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে গোয়ালন্দ থানার এসআই সেলিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৩৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। শনিবার রাতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করে। 

তৌহিদি জনতার অভিযোগ:  নুরুল হক আশির দশকের মাঝামাঝি নিজেকে ‘ইমাম মাহাদি’ বলে দাবি করেছিলেন। তখন চাপের মুখে তিনি এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। পরে আবার তিনি এলাকায় ফিরে আসেন। তার বেশ কিছু ভক্ত-অনুসারীও রয়েছে। তিনি নিজেকে খোদা বলেও দাবি করেছিলেন। তিনি কালেমা ও আজান বিকৃত করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। গত ২৩শে অগাস্ট ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। পরে তার প্রতিষ্ঠিত গোয়ালন্দ দরবার শরীফের ভেতরে কাবা শরিফের আদলে রং করা মাটি থেকে প্রায় ১২ ফুট উঁচু বেদিতে দাফন করা হয়। 

যেভাবে সহিংসতায় রূপ নেয়: নুরুল হকের মৃত্যুর পর পুরনো মতবিরোধ বেড়েছিল। স্থানীয় জনতার মধ্যে টানা উত্তেজনা চলছিল। স্থানীয় প্রশাসন দু’পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছিলেন। নুরাল পাগলার মাজারটি সরানোর দাবিতে এর আগেও বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে। কবর ও দরবার শরীফের কর্মকাণ্ড নিয়ে দিন দিন পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর সমতল করাসহ বিভিন্ন দাবি না মানলে শুক্রবার জুমার নামাজের পর ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছিল ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’। এদিন আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। বিক্ষোভ থেকে নুরাল পাগলের দরবার শরীফে হামলা চালায়। পাল্টা আক্রমণ করে নুরাল পাগলের ভক্তরাও। 

সেদিন যা হয়েছিল: দুপুরের পর দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে অংশ নেন একদল ব্যক্তি। শুরুতে পুলিশ ও স্থানীয় মুরব্বিরা তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। এতে উত্তেজিত হয়ে পুলিশের দু’টি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার একটি গাড়িতে ভাঙচুর করে তারা। এরপর নুরাল পাগলার আস্তানায় দলবেঁধে প্রবেশের চেষ্টা করে একদল ব্যক্তি। এ সময় মাজারের ভক্ত ও বিক্ষুব্ধদের মধ্যে ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে মাজারে থাকা অনেককে মারধর ও স্থাপনা ভাঙচুর শুরু করে। দরবার শরীফে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে পুলিশের ওপরও হামলা চালায়। সে সময় সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। আগুন নেভানোর পাশাপাশি আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় ফায়ার সার্ভিস। মাজারে হামলা বন্ধের এক পর্যায়ে নুরুল হকের বাড়িতে গিয়েও হামলা চালানো হয়। এ সময় বাড়ির সামনে থাকা তার কবর থেকে মরদেহ তুলে গোয়ালন্দ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন পদ্মার মোড়ে নিয়ে যায়। সেখানে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয়। 

মামলা-গ্রেপ্তার: এ ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে নড়েচড়ে বসে পুলিশ। শুক্রবার রাতে গোয়ালন্দ থানার এসআই সেলিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৩৫০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা  (ওসি) মো. রাকিবুল ইসলাম। শনিবার রাতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করে। এ বিষয়ে ওসি বলেন, অজ্ঞাত সাড়ে তিন হাজার মানুষকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে নুরাল পাগলের দরবার শরীফ এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। 

সরকারের বিবৃতি: এদিকে, এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেখানে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার নেয়ার কথাও বলা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গোয়ালন্দে নুরুল হক মোল্লা, যিনি নুরা পাগলা নামেও পরিচিত, তার কবর অবমাননা ও মরদেহে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানায়। এই অমানবিক ও ঘৃণ্য কাজটি আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের আইন এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সভ্য সমাজের মৌলিক ভিত্তির ওপর সরাসরি আঘাত।’ এই ধরনের বর্বরতা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া এ অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে বিবৃতিতে।