Image description

রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে দাবড়ে বেড়াচ্ছে কাগজে কলমে নিষিদ্ধ তিন চাকার বাহন ব্যাটারিচালিত রিকশা। শুধু অলিগলি নয়, প্রধান সড়কেও চলছে; বাদ থাকছে না ভিআইপি সড়কও। দ্রুতগ্রামী এ বাহনটি হুটহাট ডানে-বাঁয়ে মোড় নেওয়ার ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা পুলিশ সদস্যরা কখনো সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করলেই তাঁদের ওপর চড়াও হচ্ছেন চালকরা।

জানা যায়, পরিবহন হিসেবে সরকারি অনুমোদন না থাকলেও এর মধ্যে ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজপথে নেমেছে। এসব রিকশার ব্যাটারি রিচার্জ করার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ৫ হাজার চার্জিং স্টেশন। এ বাহনটি অবৈধ হলেও ব্যাটারি চার্জে বৈধ বিদ্যুৎ দিচ্ছে মন্ত্রণালয়। এদিকে আইসিডিডিআরবি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকার শিশুদের রক্তে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকর সিসার উপস্থিতির জন্য দায়ী করেছে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে। আইসিডিডিআরবির গবেষক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘রিকশাপ্রতি গড়ে ২০ কেজি সিসা হিসেবে ধরলে সারা দেশে ৪০ লাখ বাহনে প্রতি বছর ৮০ কোটি কেজি সিসা যুক্ত হচ্ছে আমাদের পরিবেশে। সিসা ধ্বংস হয় না। চিন্তা করুন, আগামী ১০ বছরে সিসাদূষণ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে!’

বাড়ছে অবৈধ চার্জিং-গ্যারেজ : রাজধানীতে রয়েছে বৈধ-অবৈধ সহস্রাধিক গ্যারেজ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীর ১০টি অপরাধ বিভাগের আটটিতে ব্যাটারিচালিত রিকশার ৩ হাজার ৩০০ বৈধ চার্জিং স্টেশন এবং ৪৮ হাজার ১৩৬টি অবৈধ চার্জিং পয়েন্ট ও ৯৯২টি গ্যারেজ রয়েছে। এসব গ্যারেজে রয়েছে আবার ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার সুবিধা। এর মধ্যে মিরপুর বিভাগের সাত থানায় আছে ৩ হাজার ৯৮৩টি চার্জিং পয়েন্ট ও ২৫৯টি গ্যারেজ। ওয়ারী বিভাগে ৩ হাজার ৫১৬ চার্জিং পয়েন্ট ও ১৩৬টি গ্যারেজ। গুলশান বিভাগে ২ হাজার ৬৪৩ চার্জিং পয়েন্ট ও ১২৮টি গ্যারেজ। উত্তরায় ১ হাজার ৩০৫ চার্জিং পয়েন্ট ও ৭২টি গ্যারেজ। মতিঝিল বিভাগে ১ হাজার ৩৯০ চার্জিং পয়েন্ট ও ৬০টি গ্যারেজ। লালবাগে ১৯৯ চার্জিং পয়েন্ট ও ৭৭টি গ্যারেজ রয়েছে। এ ছাড়া তেজগাঁও বিভাগে ২৩৪ এবং রমনা বিভাগে ২৬টি অবৈধ গ্যারেজের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। রিকশার একেকটি গ্যারেজে ৮০ থেকে ১৫০টি রিকশা রাখা হয়।

সহস্রাধিক কারখানা : অনুসন্ধানে নেমে একটি সংস্থার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিনই ঢাকার সড়কে যোগ হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ ব্যাটারিচালিত রিকশা। রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর, কেরানীগঞ্জ, কমলাপুর, সবুজবাগ, মান্ডা, গাজীপুর, টঙ্গীতে থাকা অন্তত ১ হাজার কারখানায় তৈরি হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। একটি ব্যাটারিতে তৈরি অটোরিকশার দাম ৮০ হাজার টাকা। তবে চার ব্যাটারিতে তৈরি অটোরিকশার দাম পড়ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। এদিকে দেশ অস্থিতিশীল করার জন্য ব্যাটারি রিকশাচালকদের ব্যবহারের ষড়যন্ত্র করছে পতিত হাসিনা সরকার। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ঢাকায় এনে ব্যাটারি রিকশার চালক হিসেবে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাস্তায়। স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে তাঁরা তদন্ত শুরু করে দিয়েছেন বলেও জানান।

১০ লাখ ব্যাটারি রিকশা : ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র বলছেন, বর্তমানে রাজধানীর সড়কে চলছে প্রায় ১০ লাখ ব্যাটারি রিকশা। এসব রিকশার চার্জিং স্টেশনের বেশির ভাগেই ব্যবহার হচ্ছে অবৈধ লাইন টেনে নেওয়া বিদ্যুৎ। তবে অভিযান চলাকালে অবৈধ লাইন খুলে রাখা হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের অসাধু চক্র এবং স্থানীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে দিনের পর দিন এগুলো চলে আসছে।

রামপুরার মিরবাগে ‘রাব্বি স্টোর’ নামে একটি অটোরিকশা গ্যারেজ ও কারখানার মালিক মিজানুর রহমান। গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, প্রায় দুই বছর থেকে সেখানে সাধারণ রিকশা ব্যাটারিচালিত রিকশায় রূপান্তরের কাজ চলছে। একই সঙ্গে এখানে ৩৫০টি ব্যাটারি রিকশার চার্জের কাজ করা হয়।

ব্যাটারি চার্জে বৈধ বিদ্যুৎ দেয় মন্ত্রণালয় : সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ ওয়াট হিসেবে ৫ থেকে ৬ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। সে হিসেবে প্রায় ১০ লাখ ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ গ্যারেজে চুরি করে ও লুকিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এসব ব্যাটারি রিচার্জ করায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজধানীতে নিষিদ্ধ হলেও ব্যাটারি চার্জে অনুমতি দিয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। তাদের অনুমোদিত ৩ হাজার ৩০০ চার্জিং স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে ডিপিডিসির রয়েছে ২ হাজার ১৪৯টি। ডিপিডিসির তথ্যানুযায়ী, তাদের প্রতিদিন বিদ্যুৎ খরচ ২৬ দশমিক ১৬২ মেগাওয়াট। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) ইঞ্জিনিয়ার কিউ এম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশার চার্জিং স্টেশনে বিদ্যুৎ দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু না দিলে তারা অবৈধভাবে চুরি করে চার্জ করবে। এতে আমাদের বিদ্যুৎ অপচয় হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চুরি করে চার্জ দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের নিয়মিত টহল টিম মনিটরিং করছে। তবে যেখানে আমরা খবর পাচ্ছি সেখানে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানাসহ যন্ত্রাংশ খুলে নেওয়া হচ্ছে।’

অনুমোদন পেতে পাঁচ কোম্পানির আবেদন : বুয়েট বিশেষজ্ঞদের করা নকশা অনুযায়ী অটোরিকশার অনুমোদন পেতে পাঁচটি কোম্পানি সিটি করপোরেশনে আবেদন করেছে। সেগুলো হলো মনির অটো ইঞ্জিনিয়ারিং লি., আকিজ মোটরস, নিউ গ্রামীণ, ডায়নামিক ও ডায়স্টার হাইটেক অটো লিমিটেড। আগামী সপ্তাহে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা কোম্পানিগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করবেন। পরিদর্শন শেষে রিপোর্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয় যে কোম্পানির বিষয়ে রাজি হবে সেটা তাঁরা করবেন বলে জানালেন সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

মারাত্মক ঝুঁকিতে শিশুরা : আইসিডিডিআরবির (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ) গবেষণায় উঠে এসেছে, ব্যাটারি পোড়ানোর পরও ৮০ ভাগ সিসা ফেরত থাকে। ২০ ভাগ মাটি, নদী, খাল, বিলসহ পরিবেশে নিক্ষিপ্ত হয়। এসব সিসা মাছ, হাঁস-মুরগি ও অন্যান্য প্রাণীর শরীরে গিয়ে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। নারীর শরীর থেকে শিশুর মধ্যে চলে আসে। দেশের আনাচকানাচে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে লোকচক্ষুর আড়ালে অনানুষ্ঠানিক ‘ব্যাটারি ভাঙার কারখানা’ গড়ে উঠেছে। সেখানে ছোট ছোট শিশু এবং অত্যন্ত দরিদ্র মানুষ কোনোরকম সুরক্ষা ছাড়াই ব্যাটারি ভেঙে পানিতে ধুয়ে সিসা বের করার কাজ করে। আবার ব্যবহৃত সিসা আগুনে গলিয়ে গোলা তৈরি করে নতুন ব্যাটারি তৈরির কারখানায় বিক্রি করা হয়। এ বিষয়ে আইসিডিডিআরবির গবেষক ড. মাহবুবুর রহমান জানান, তাঁরা ঢাকা শহরের নিম্ন, মধ্য এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের ৫০০ শিশুর ওপর জরিপ চালিয়েছেন। সেখানে দেখা গেছে, ৯৮ শতাংশ বাচ্চার রক্তে সিসার মাত্রা ৩৫ মাইক্রোগ্রাম/ডেসিলিটার। একটি শিশুর রক্তে প্রতি ডেসিলিটারে ৪৬ মাইক্রোগ্রাম সিসা পাওয়া গেছে। যেখানে রক্তে সিসার সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য পরিমাণ সাড়ে ৩ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার। অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুই বছর আগেও এ সংখ্যা ছিল ২ লাখ। বর্তমানে ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। বিশেষ করে হাসিনা সরকার পতনের দুই মাস আগে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিষয়ে ইতিবাচক কথা বলার পরই তা হুহু করে বাড়তে থাকে। অ্যাসিড ব্যাটারিতে চালিত এসব পরিবহন পরিবেশের জন্যও ভয়ংকর। প্রণীত নীতিমালায় অ্যাসিড ব্যাটারির স্থলে লিথিয়াম ব্যাটারি বাধ্যতামূলক করা হলেও দেশে এখন পর্যন্ত কোনো লিথিয়াম ব্যাটারির রিকশা নেই।

নগরীর ক্যানসার ব্যাটারি রিকশা : বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেছেন, ‘রাজধানীর ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো ক্যানসারে পরিণত হয়েছে। এ ক্যানসার এখন সর্বশেষ স্টেজে রয়েছে। যে কোনো সময় বিপদ ঘটাতে পারে। এটা নিয়ে সরকারকে দ্রুত কাজ করতে হবে। না হলে ঢাকাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।’ তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে অর্থাৎ ২০১৪ সালে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন সরকার, ওই সময় যদি কঠোর হয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যেত তাহলে আজ এ অবস্থায় পড়তে হতো না। বিগত সময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও নিয়ন্ত্রণ না করায় এখন সড়কে আধিক্য তাদের।’ কাজী সাইফুন নেওয়াজ আর বলেন, ‘এ রিকশা রাস্তায় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অবৈধভাবে তৈরি হওয়া কারখানা ও চার্জিং স্টেশনগুলো বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে ব্যাটারি আমদানি নিয়ন্ত্রণ, কারখানা এবং চার্জিং স্টেশনগুলো বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বন্ধ করে দেওয়াসহ সরকারকে কঠোর হতে হবে।’

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বর্তমানে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে। রাজধানীতেই রয়েছে ৮ লাখের ওপরে। চট্টগ্রামে রয়েছে ৩ লাখ। এসব পরিবহন প্রধান সড়কের জন্য খুবই বিপজ্জনক। এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘খুব কৌশলে এ ব্যবসার জন্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্রামীণ অটো এবং আকিজ মোটরসের নাম শুনতে পেয়েছি। ওয়ালটনও নাকি আসছে। শুনেছিলাম যাত্রী নিরাপত্তার জন্য বেষ্টনীসহ সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় নিশ্চিত করে গাড়ি ডিজাইন করার কথা। কিন্তু যে ডিজাইন অনুমোদন করা হয়েছে সেগুলো মানসম্পন্ন মনে হয়নি। তারা যদি একই মানের গাড়িগুলো পারমিশন দেন তাহলে সড়কে থাকাগুলোকে দেবেন না কেন? হাসিনা সরকার সাধারণ মানুষের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিত। বর্তমান সরকারও আমলাদের খপ্পর থেকে বেরোতে পারছে না। অংশীজনদের মতামত নেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করছে না তারা।’