
মাছ, মাংস, দুধ, ডিমসহ আমিষ উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জায়গা করে নেওয়া সত্ত্বেও দেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। এই সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে। জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশের অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। সে হিসাবে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি ধরা হলে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। আর যদি জনসংখ্যা ধরা হয় ২০ কোটি, তাহলে অপুষ্টিতে ভোগা জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২ কোটি। এর মধ্যে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নারী ও শিশু। সহসাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের তেমন কোনো সম্ভাবনাও নেই। কেননা সাম্প্রতিক সময়ে কর্মসংস্থানের অভাব ও দরিদ্রতার কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। যার ফলে রোগ বালাইও বাড়ছে। এতে করে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দেশের জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি।
তবে আশার দিক হচ্ছে এই অপুষ্টিজনিত সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রতিবেশী অন্য দুই দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও মাত্র বছর খানেক আগে শ্রীলঙ্কায় বয়ে গেছে চরম এক আর্থিক বিপর্যয়। তবে সেই বিপর্যয় দেশটি বেশ দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটার মধ্য দিয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় এখনো তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। ফলে দারিদ্র্যের হার এবং বেকারের সংখ্যা আরও বেড়েছে। একই সঙ্গে নতুন করে বেকার হয়েছে অসংখ্য মানুষ। যার ফলে অপুষ্টিজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব সামনে আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যকর বা সুষম খাদ্য গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশ রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে। এ বিষয়ে গত সাত বছরে অনেকটা উন্নতি হলেও এখনো দেশের ৭ কোটি ৭১ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না। দেশের ১০ শতাংশের বেশি মানুষ অপুষ্টির শিকার। এ অবস্থা থেকে বেরোনোর জন্য বাংলাদেশকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। গত আগস্টের শুরুতে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’-এ এ তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থা মিলে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংস্থাগুলো হলো এফএও, ইফাদ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফ। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রতিবেদন নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। যদিও দেশের কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা দরিদ্রতা বৃদ্ধি, আয় ও ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার ওপর একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানুষের আয় কমে যাওয়ায় মানুষ পুষ্টিকর খাবার কম খাচ্ছে। অবশ্য অনেকেই বাধ্য হয়ে তাদের খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনছেন। এক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি মানুষের আয় বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
ওই প্রতিবেদনে ২০০৪ থেকে ২০০৬ এবং ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অপুষ্টির শিকার মানুষের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দেখা গেছে, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে অপুষ্টির শিকার মানুষের হার ছিল মোট জনসংখ্যার ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। এটি ২০২২ থেকে ২০২৪ সালে এসে হয় ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। এখন ভারতের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ অপুষ্টির শিকার, পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৫ আর আফগানিস্তানে ২৮ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপালে অপুষ্টির শিকার দেশটির মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ৩ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
প্রতিবেদন বলা হয়, বাংলাদেশে সুষম খাদ্যের জন্য ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতা অনুসারে জনপ্রতি ব্যয় ৪ দশমিক ৪৯ ডলার। আগের বছর এটি ছিল ৪ দশমিক ৩৩ ডলার। দক্ষিণ এশিয়ায় এ হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এক্ষেত্রে শীর্ষে আছে ভুটান। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সূষম খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে থাকায় এটাতে ইতিবাচক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যদিও দেশের দুই কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড অনুযায়ী, সুষম খাদ্য গ্রহণের খরচ বলতে বোঝানো হয় একজন ব্যক্তির দৈনিক ২ হাজার ৩৩০ কিলোক্যালরি শক্তির চাহিদা পূরণ করে এমন খাদ্যের জন্য স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য এবং সবচেয়ে সাশ্রয়ী খাবার কেনার ব্যয়ের সক্ষমতা।
এতে আরো বলা হয়, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত ওজন কম থাকার হার বাংলাদেশে ১০ শতাংশ। ভারতে এ হার ১৮ এবং পাকিস্তানে ৭। বাংলাদেশে এ বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বকায় অন্তত ২৫ শতাংশ। ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে তা ৩৩ ও প্রায় ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে খাদ্য উৎপাদন এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে। কিন্তু তারপরও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র “দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২২” প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুক্ত জলাশয় বা স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের মাছের দাম বৃদ্ধি পাওয়া এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় প্রতিদিনেরে খাদ্য তালিকায় মাছ গ্রহণের মাত্রা কমেছে। একইভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএউচও) মনে করে প্রতি ব্যক্তির জন্য দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে প্রকৃত গ্রহণ সে হিসেবের চেয়ে অনেক কম। গৃহস্থালী আয় ও ব্যয় সমীক্ষা (এইচআইইএস) ২০২২ অনুসারে, দেশে দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের গড় মাথাপিছু দৈনিক ভোগ মাত্র ৩৪.১ গ্রাম।
এছাড়া মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ৪০টি দেশের মধ্যে নেই। তবে গরু, ছাগল, হাস-মুরহিসহ গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২তম এবং সামগ্রিকভাবে মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে একটি। তবুও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।