Image description
 

২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশি দুই বৃদ্ধার আটকের খবর প্রকাশিত হয়। আদো বর্মণ এবং কাঞ্জু বালা নামের দুই হিন্দু ধর্মাবলম্বী বয়স্কা নারী অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাদের আটক করে।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘু দুই বৃদ্ধার ভারতে অনুপ্রবেশের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে কলকাতা-ভিত্তিক দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন, এবিপি আনন্দ, টিভি নাইন, হিন্দু সমাচার-সহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম।

এর মধ্যে সংবাদ প্রতিদিনের শিরোনাম ছিল, “মেয়েকে ছিঁড়ে খেয়েছে’, এপার বাংলায় এসে হাড়হিম হিন্দু নির্যাতনের কথা শোনালেন বাংলাদেশি বৃদ্ধা”।

পত্রিকাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শিরোনামের নিচে আরো একটি লাইন লেখা হয়েছে, “বন্দি হয়ে এপারে থাকতে রাজি, তাও ওপারে ফিরতে চান না বৃদ্ধা।”

 

 

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন ভারতপন্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আছে তা বৃদ্ধা কাঞ্জু বালার বয়ানে তুলে ধরেছে ’সংবাদ প্রতিদিন’।


’এক হিন্দু নারীর ৮ সন্তানের ৫ জনই খুন-ধর্ষণ-গুমের শিকার’

শংকরকুমার রায় নামক রিপোর্টারের লিখিত প্রতিবেদনটিতে শুরু করা হয়েছে এভাবে:

“বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে মেয়েকে খুন মৌলবাদীদের। পরে দেহ উদ্ধার হলেও সাহস করে সৎকারে এগিয়ে আসেনি কেউ। প্রতিমুহূর্ত কেটেছে মৃত্যুর আতঙ্কে। শেষে ঘরছাড়া হতে হয়েছে। কাঁটাতার পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে গিয়ে বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে পদ্মাপারের নারকীয় অত্যাচারের কথা জানালেন বাংলদেশের দিনাজপুরের গাজিপুরের বৃদ্ধা। ভেঙে পড়লেন কান্নায়।”

পুরো প্রতিবেদনটি কাঞ্জু বালার বক্তব্য নির্ভর। ইন্ট্রোর পরের প্যারায় উঠে এসেছে কিভাবে কাঞ্জু বালার মোট ৮ সন্তানের সবাই কিভাবে ৫ আগস্টের পরের বাংলাদেশে ভয়াবহ নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন।

সংবাদ প্রতিদিন লিখেছে:

“বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার গাজিপুর থানার যথাইসুদপুর গ্রামের বাসিন্দা ওই বৃদ্ধা। বয়সের কারণে চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়েছে। সামনের মানুষজনদেরও ঝাপসা দেখেন। বুধবার (১১ ডিসেম্বর) রাতে কাঁটাতার পেরিয়ে বাংলার উত্তর দিনাজপুরে প্রবেশের সময় বিএসএফের হাতে ধরা পড়েন তিনি। এর পরই পদ্মাপাড়ের নারকীয় অত্যাচারের বর্ণনা করেন বৃদ্ধা। জানান, তিনি পাঁচ কন্যা ও তিনপুত্রের মা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় বড় ছেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় মৌলবাদীরা। তার পর আর খোঁজ নেই তাঁর। আর এক ছেলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনও হদিশ নেই। পাঁচ মেয়ের মধ্যে দুজন না খেতে পেয়ে অসুস্থ হয়ে ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে। ছোট মেয়ে মৌলবাদীদের লালসার শিকার।”

এই বর্ণনায় কাঞ্জু বালার ৫ মেয়ে এবং ৩ ছেলে; মোট ৮জন।

এর মধ্যে এক মেয়েকে ধর্ষণের পর খুন করেছে মৌলবাদীরা। দুই মেয়ে না খেতে পেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। ছেলেদের মধ্যে বড়জনকে মৌলবাদীরা গুম করেছে আর একজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে রাস্তায় ঘুরছেন।

অর্থাৎ, ৮ সন্তানের ৫ জনই ভুক্তভোগী। একজন ধর্ষণ ও খুনের শিকার, একজন গুম, দুইজন অনাহারে মৃত এবং একজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। রিপোর্টে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে এইসব নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে পরিবারটিকে শেখ হাসিনার পতনের পর।

কাঞ্জু বালাকে নিয়ে কাছাকাছি গল্প প্রকাশিত হয়েছে এবিপি আনন্দটিভি নাইনহিন্দুস্তান সমাচারশীর্ষ টাইমসইটিভি ভারত ইত্যাদি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে।

সংবাদ প্রতিদিন এর অনলাইন প্রতিবেদনে ওই বৃদ্ধার বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে নানান তথ্য দেয়া হলেও তার নাম দেয়া হয়নি। তবে একই দিনের (১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪) ই-পেপারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আলোচ্য বৃদ্ধার নাম ‘কাঞ্জুবালা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংবাদ প্রতিদিনের ই-পেপারের রিপোর্ট

 

ইটিভি ভারত-এর প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনেও তার নাম ’কাঞ্জু বালা’ বলে জানানো হয়েছে। এই সংবাদমাধ্যমটির ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা যায় একজন ভারতীয় বাংলাভাষী সাংবাদিক কথা বলছেন কাঞ্জু বালার সাথে। তাদের কথপোকথনটির অংশ বিশেষ নিচে দেয়া হল:

সাংবাদিক: ভারতে কেন আসছেন?

কাঞ্জু বালা: বেটির বাড়ি আসছি বাবা।

সাংবাদিক: বাংলাদেশে কি মারধর করছে?

কাঞ্জু বালা: হ্যাঁ, অত্যাচার করছে।

সাংবাদিক: কাঁটাতার পার হয়ে আসছেন?

কাঞ্জু বালা: হ্যাঁ।

সাংবাদিক: বাংলাদেশে কী অবস্থা?

কাঞ্জু বালা: অবস্থা... অত্যাচার খুব করে। নিজের জায়গা নাই। থাকিত দেয় না। বাড়িঘর ভাঙি দিছে। মাইরধর করছে।

সাংবাদিক: কী বলছে ওরা? কী চাচ্ছে?

কাঞ্জু বালা: হিন্দুক দেখতে পারছে না।

সাংবাদিক: হিন্দুদের দেখতে পারছে না সেজন্যে চলে আসছেন ভারতে?

কাঞ্জু বালা: হ্যাঁ, বেটি থাকে জাইরন, গঙ্গারামপুর থানা আর ইট কাটে।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর ভারতীয় মিডিয়ার একাংশ এবং সোশাল মিডিয়ায় ধারাবাহিকভাবে যে ক’টি বয়ান প্রচার করা হয়েছে তার মধ্যে একটি ছিল ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর গণহত্যা’ চলছে। কাঞ্জু বালা সংক্রান্ত এই রিপোর্টটিতে তেমনি একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

এই সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনা মোটেও ঘটেনি তা নয়। একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে এবং তাদের ওপর আক্রমণের ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত দাবি করেছে।

তবে একই সাথে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাগুলো তাদের বহু প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু পরিস্থিতিকে অতিরঞ্জিত করে এবং এই ইস্যুতে অসংখ্য অসত্য তথ্য প্রচার করেছে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে একাংশ।

The Dissent এই কাঞ্জু বালার ঘটনাটি অনুসন্ধানে নামে। তার বাড়ি কোথায় এবং তার পরিবারের সাথে আদৌ এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা তা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করে।


ভুল ঠিকানা

’কাঞ্জুবালা’র যে ঠিকানা দেয়া হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে সেটি ভুল ছিল। একাধিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি ‘বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার গাজিপুর থানার যথাইসুদপুর গ্রামের বাসিন্দা।’

কিন্তু বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলায় ‘গাজিপুর’ বলে কোন থানা নেই এবং একই জেলায় ‘যথাইসুদপুর’ নামের কোন গ্রামও নেই।

ইটিভি ভারত-এর ভিডিও প্রতিবেদনে দেয়া সাক্ষাৎকারে ‘বাংলাদেশে কোথায় বাড়ি?’ এমন প্রশ্নের জবাবে কাঞ্জু বালা বলেন, ‘যশাই হাট, শুদ্ধপুর (বা শুকদেবপুর)।

The Dissent দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ‘যশাই হাট’ নামের একটি বাজারের সন্ধান পায়; যার নিকটবর্তী একটি গ্রামের নাম ‘পশ্চিম শুকবেদবপুর’। ওই গ্রামে কাঞ্জুবালা ও তার বড় ছেলের পরিবার বাস করেন।

তার পরিবারের কাছ থেকে ‘কাঞ্জুবালা’র এনআইডি সংগ্রহ করে দেখা গেছে তার নামের বানান ‘কাইঞ্চো বালা’ (Kaincho Bala)। জন্ম তারিখ ১৩ জুলাই ১৯৩৭।


কাইঞ্চো বালার বাড়িতে The Dissent টিম

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে কাইঞ্চো বালার পরিবারকে সনাক্ত করার পর জুন মাসে তাদের বাড়িতে যায় The Dissent টিম।

পশ্চিম শুকদেবপুর গ্রামে কাইঞ্চো বালার বড় ছেলে রবিদাশ রায়ের পরিবার বসবাস করছে। দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন এর খবর মতে, এই ছেলেকে ‘সরকারের পতনের পর সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় অপহরণ করে নিয়ে যায় মৌলবাদীরা’। ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ এর আগে কাঞ্জু বালাও তাদের সাথে একই বাড়িতে বসবাস করতেন।

তাদের বাড়িতে The Dissent টিম কথা বলেছে কাইঞ্চো বালার বড় ছেলে রবিদাশ রায়ের স্ত্রী আরতি বালা এবং রবিদাশ-আরতি দম্পতির দুই ছেলে নিতাই রায় ও অর্জুন রায়ের সাথে; যারা কাইঞ্চো বালার নাতি।

কাইঞ্চো বালার বড় ছেলে রবিদাশের বাড়িতে তার স্ত্রী ও ছেলেরা

 

নিতাই ও অর্জুনের আরো এক ভাই আছেন যার নাম সাগর রায়। তিনি সবার বড়। অর্থাৎ, কাইঞ্চো বালার বড় ছেলের ঘরের বড় নাতি।

পরিবারের তথ্য মতে, সাগর জন্মগতভাবেই কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। মানসিক অবস্থা ভাল থাকলে এবং তার ইচ্ছা হলে কখনো অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেন। আবার মাঝে মাঝে ভবঘুরের মতো চলাফেরা করেন।

আরতি মালা জানালেন, পারিবারিক বিরোধের জেরে আনুমানিক ২০০০ সালের পর (সঠিক সালটি কেউ বলতে পারেন নি) একদিন রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান রবিদাশ রায়। এরপর আর কেউ তার খোঁজ পায়নি। তিনি কি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন পরিবার জানে না। এর আগে জীবিকার জন্য মৌসুমভিত্তিক কাজে তার বাবা দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকতেন বলে জানান মেঝ ছেলে নিতাই রায়।

ছোট ছেলে অর্জুন এখন যুবক। এখন নিজের একটি ভ্যানগাড়ি চালান। আগে মানুষের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতেন। তার জন্মের পরেই নিখোঁজ হন বাবা রবিদাশ। তিনি বলেন, ‘বাবার কোনো স্মৃতি আমার মনে নাই।’

নিতাই জানান, তার দাদা তৈলক্ষ চন্দ্র রায় ও দাদী কাইঞ্চো বালা দম্পতির দুই ছেলে ও তিন মেয়ে ছিলেন। সবার বড় ছেলে রবিদাশ রায় (যিনি ২০০০ সালের পর থেকে নিখোঁজ), আর ছোট ছেলে মানিক চন্দ্র রায়, যিনি পার্বতীপুরের পাশের উপজেলা চিরিরবন্দরের অমলপুর গ্রামে পরিবার নিয়ে বাস করেন। তিনি ইটভাটার শ্রমিক। ইটভাটায় কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করেন মানিক। The Dissent তারও সাক্ষাৎকার নিয়েছে।

কাইঞ্চো বালা ও তার ছোট ছেলে মানিক চন্দ্র রায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র

মানিক চন্দ্র রায় জানান, তার তিন বোনের মধ্যে বড় বোন বানেশ্বরী রায় কয়েক বছর আগে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তার পরিবার ভারতে রয়েছে।

দ্বিতীয় বোন শেফালী রায়কে ভারতে বিয়ে দেওয়া হয়েছে বহু বছর আগে; বর্তমানে তিনি সেখানে বসবাস করছেন। মানিক আরো জানান, তার মা কাইঞ্চো বালা ভারতে বর্তমানে এই মেয়ের বাড়িতেই আছেন বলে তারা জানেন।

এবং তৃতীয় বোন ডলি রানি রায় শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ছিলেন। ২০০৬-২০০৭ সালের দিকে তিনি মারা গেছেন। (নির্দিষ্ট দিন-তারিখ উল্লেখ করতে পারেন নি)।

কাইঞ্চো বালার বড় ছেলের বউ আরতি বালা এবং দুই নাতি নিতাই এবং অর্জুনও একই তথ্য দিয়েছেন।

অর্থাৎ, কাইঞ্চো বালার পরিবারের তথ্য মতে, তার সন্তানের সংখ্যা মোট ৫ জন; যেখানে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোতে বলা হয়েছিল ৮ জন।

৫ সন্তানের মধ্যে ২ ছেলে ৩ মেয়ে। তাদের মধ্যে এক ছেলে (মানিক চন্দ্র রায়) বেঁচে আছেন এবং অপর ছেলে (রবিদাশ রায়) ২০০০ সালের পর থেকে নিখোঁজ।

৩ মেয়ের মধ্যে বড়জন বানেশ্বরী রায় মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। দ্বিতীয় মেয়ে শেফালী রায় ভারতে আছেন বহু বছর ধরে এবং তৃতীয় মেয়ে মারা গেছেন ২০০৬-০৭ সালের দিকে।

৫ সন্তানের মধ্যে ৩ জনের মৃত্যু ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে ৫ আগস্টের বহু বছর আগে। এবং মৃত্যুগুলো স্বাভাবিকভাবেই ছিল বলে পরিবারের অন্য সদস্যরা জানাচ্ছেন।

বেঁচে থাকা ২ সন্তানের মধ্যে একজন ভারতে থাকেন ৫ আগস্টের বহু আগে থেকে। এবং অন্যজন (ছেলে মানিক চন্দ্র) পরিবারসহ দিনাজপুরে বসবাস করছেন এবং সুস্থভাবে ইটভাটায় কাজ করে পরিবার চালাচ্ছেন।

মানিক চন্দ্র রায় বলেন, ‘মা আমার এখানে (চিরিরবন্দরে মানিকের বাড়িতে) মাঝে মাঝে থাকতেন। মাঝে মাঝে শুকদেবপুর (পার্বতীপুরে) থাকতেন। আমার বাড়িঘরে কখনো হামলা হয়নি। পার্বতীপুরে কিছু হলে আমার জানা নেই।’

‘উনি কবে কেমনে ভারতে গেল তা আমারে কয় নাই কিছু। আমার বোনের বিয়ে হয়েছে ভারতে। হয়তো ওর বাড়িতে গেছে’, বলেন মানিক।

কাইঞ্চো বালার ছোট ছেলে মানিক চন্দ্র রায় ও ভাতিজা খোকন চন্দ্র রায়ের সাথে কথা বলছেন The Dissent এর প্রতিনিধি

 

কাইঞ্চো বালার বড়ছেলের বউ আরতি বালা এবং নাতি নিতাই রায় ও অর্জুন রায় জানান, তাদের গ্রাম শুকদেবপুরেও (পার্বতীপুর উপজেলা) ৫ আগস্টের পর কোন, বিগত বছরগুলোতেও হিন্দুদের বাড়িঘরে কোন হামলা বা সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।

ভারতীয় মিডিয়ায় কাইঞ্চো বালার বরাতে তাদের বাড়িঘরে হামলা এবং পরিবারের সদস্যদের ধর্ষিত ও খুন হওয়ার যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো দেখানো হলে নিতাই রায় বিস্মিত হন।

‘আমি বুঝতেছি না দাদী এমন কথাবার্তা কেন বলবে! ভারতে ঢুকার সময় বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে ভয়ে এসব বলছে হয়তো’, বলেন নিতাই।

নিতাই বলেন, “আমাদের এই পাড়াটা নতুন। বছর তিনেক হয়েছে এই পাড়ায় আমরা ঘর করেছি। আগে পাশের আরেক পাড়ায় (শুকদেবপুরেই) ছিলাম। তিন বছর ধরে আমরা হিন্দু মুসলিম সবাই মিলেমিশেই থাকি। সবাই যার যার কাজকাম করি। একটা সংগঠন আমাদের এখানে একটা মন্দিরের জন্য পাকা ঘর তৈরি করে দিচ্ছে। আমাদের এখানে কোন ঝামেলা কখনও হয়নি।”

 

স্থানীয়রা কী বলছেন?

কাইঞ্চো বালার ভাতিজা ও স্থানীয় পূজা আয়োজক খোকন চন্দ্র রায় বলেন, কাইঞ্চো বালা ছোট ছেলের বাড়ি অমলপুরে থাকতেন, মাঝে মাঝে পশ্চিম শুকদেবপুর এলাকায়ও থাকতেন।

তিনি বলেন, “উনি মেঝো মেয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় ভারতে গেছেন। তাকে তার বাড়ি থেকে রেব করতে কেউ বাধ্য করে নাই। ধরা পড়ে উনি বানোয়াট কথা বলেছেন। আমাদের এখানে কোন হামলার ঘটনাই ঘটেনি।”

পশ্চিম শুকদেবপুর গ্রামের ওয়ার্ড মেম্বার খালেদ মাহমুদ সুজন কাইঞ্চো বালার ছোট ছেলে মানিকের এক সময়ের ক্লাসমেট। তারা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে একসাথে পড়াশোনা করেছেন।

“চাচীরে তো আমি চিনি। উনি দুই ছেলের পরিবারের সাথেই থাকতেন। মাঝে মাঝে চিরিরবন্দরে মানিকের বাড়িতে যেতেন। মাঝে মাঝে এখানে থাকতেন” বলেন সুজন।

তিনি বলেন, ‘উনার ২ ছেলে আর ৩ মেয়ে ছিল। বড় ছেলে আমরা ছোট থাকতেই হারিয়ে যান। দুই মেয়েও অনেক বছর আগে মারা গেছেন বলে জানি। আমাদের ওয়ার্ডে হিন্দু মানুষজন বেশি মুসলমানের চেয়ে। ৫ আগস্টের আগে বা পরে এখানে কোন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়নি।’

পার্বতীপুর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নজরুল সরকারের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, “আমার ইউনিয়নে যদি এমন ভয়ানক ঘটনা ঘটত, তাহলে আমি অবশ্যই জানতাম। একটা পরিবারের এতজন লোক এত নির্যাতনের শিকার হলে সারা দেশ তা জানতো। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন খবর।”

 

কী বলছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের রিপোর্ট

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন হচ্ছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। প্রতি বছর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনাবলী নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করে সংস্থাটি। বাংলাদেশে ঘটা সংখ্যালঘু নিপীড়নের উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা তাদের রিপোর্ট থেকে বাদ পড়ে না।

বরং মাঝে মাঝে তাদের রিপোর্ট বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এ কারণে যে, সংখ্যালঘু নিপীড়নের কোন প্রমাণ না থাকার পরও সংখ্যালঘু কোন ব্যক্তির মৃত্যু বা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাকে সংস্থাটি ‘সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনা’ বলে তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নানান সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে ও সম্পত্তিতে যেসব হামলা এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তার উপর দুটি আলাদা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।

এর মধ্যে একটি রিপোর্টে ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সংখ্যালঘুর ওপর হামলার ঘটনাবলী রেকর্ড করা হয়েছে, যার সংখ্যা ২০১০টি বলে সংস্থাটির দাবি। অন্য রিপোর্টে ২১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৭৪টি হামলার ঘটনার কথা বলা হয়েছে। রিপোর্ট দুটি ঐক্য পরিষদের ওয়েবসাইটে এখানে দেখা যাবে।

উভয় রিপোর্টে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার সব অঞ্চলের ডাটা রয়েছে। দিনাজপুর জেলার একাধিক অন্য ঘটনার বিবরণ রয়েছে। কিন্তু এর কোনটিতেই দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলারে পশ্চিম শুকদেবপুরে হামলার কোন ঘটনারই উল্লেখ নেই; সেখানে একই পরিবারের একাধিকজনকে ধর্ষণ বা হত্যা কিম্বা গুম করার তথ্য তো দূরের কথা।

এ বিষয়ে জানতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দীপঙ্কর ঘোষের সাথে ২০২৫ সালের জুলাই মাসে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের যেসব ঘটনার তথ্য আমাদের জানার মধ্যে ছিল সেগুলো আমাদের দুটি রিপোর্টে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দিনাজপুরের পার্বতীপুরে হিন্দু নারীকে ধর্ষণের পর খুন বা তার ভাইকে গুম করার কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই।