Image description

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণের পর থেকেই গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি আরও জোরালো করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। তাদের মতে, এর মাধ্যমে রচিত হবে নতুন সংবিধান। সাম্প্রতিক সময়ে দলীয় প্রতিটি কর্মসূচিতেই এ প্রস্তাবের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখছেন দলটির নেতারা। এমনকি গণপরিষদ নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচনে না যাওয়ারও ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন তারা।

ছয় মাস বয়সী রাজনৈতিক দলটির এ দাবি নিয়ে ইতোমধ্যে নানা আলোচনা হচ্ছে। কারণ এনসিপির শীর্ষ নেতারাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন। তাই তাদের দাবি হালকা করে দেখছেন না অন্যান্য দলের নেতারাও। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মতামত দিচ্ছেন। কেউ কেউ একে নির্বাচন প্রলম্বিত করার কৌশল হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ মুহূর্তে গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না তারা। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় গণপরিষদ নির্বাচনের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু? এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

গণপরিষদ নির্বাচন  এনসিপির প্রস্তাব

 

গণপরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই পরবর্তীতে নতুন সংবিধান পুনর্লিখনের কাজ এবং সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবেন। বিধি অনুসারে পরাধীন উপনিবেশে সংবিধান কমিটির সদস্যরা সরকারের নিয়োগ বা অন্য কোনও উপায়েও নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারেন। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় এ ধরনের নির্বাচনের প্রচলন নেই।

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সাল থেকে সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু এত বছর গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি ওঠেনি। মূলত চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো গণপরিষদ নির্বাচনের প্রস্তাব দেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে তিনি আবারও সেকেন্ড রিপাবলিক বা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গণপরিষদ নির্বাচনের প্রস্তাব দেন। এ সময় তিনি বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলেরও দাবি জানান।

 

এরপর থেকেই দলটির প্রতিটি সভা-সমাবেশ থেকেই এ নিয়ে কথা হচ্ছে। গত ১২ আগস্ট রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে জাতীয় যুবশক্তির সমাবেশে এই দাবির পক্ষে বক্তব্য রাখেন নাহিদসহ এনসিপির শীর্ষ নেতারা।

গত ২১ আগস্ট রংপুরের কাউনিয়ায় দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। এ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।

সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও গণপরিষদ নির্বাচনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন দলটির নেতারা। সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি এবং সাংবিধানিক ভিত্তির জন্য আগামী যে নির্বাচনটি হবে তা যেন অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন হয়। আশা করি এর মাধ্যমে বিগত ৫৪ বছরে গড়ে ওঠা স্বৈরতান্ত্রিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাঠামোর কিছুটা সমাধান হবে।’                                                           

ইতিহাসের বাঁক

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে সংবিধান সভা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিকতায় এ সংবিধান সভার নামকরণ হয় গণপরিষদ হিসেবে। মূলত পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের জারি করা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (১৯৭০)-এর অধীনে নির্বাচিত বিজয়ী প্রতিনিধিদের নিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম গণপরিষদ গঠন হয়েছিল।

তবে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বদরুদ্দীন উমর, আ স ম আবদুর রব ও ফরহাদ মজহারসহ অনেকে এ সংবিধান সভাকে অবৈধ আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেন। তারপরও এক বছরেরও কম সময়ে সেই গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করে তা ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রবর্তন করতে সক্ষম হন। এরপর অবশ্য আর হয়নি গণপরিষদ নির্বাচন।

ইসির পরিকল্পনা

এই মুহূর্তে গণপরিষদ ও গণভোট নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনও পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন-ইসি। ২৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া সেন্টারে জাতীয় নির্বাচনের পথনকশা ঘোষণা অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এ কথা জানান ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ।

তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী এ মুহূর্তে আমরা জাতীয় নির্বাচন ছাড়া কিছুই ভাবছি না। সে অনুযায়ীই আমাদের যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে।’ এদিন জাতীয় নির্বাচনের পথনকশা ঘোষণা করে ইসি। সে অনুযায়ী ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শুরু হবে। তা চলবে অক্টোবর পর্যন্ত। নভেম্বরে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ, ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণা ও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে ভোট। সে অনুযায়ী গণপরিষদ নির্বাচনের কোনও সুযোগ নেই।

কীভাবে দেখছেন রাজনীতিবিদ  বিশ্লেষকরা

বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণপরিষদ নির্বাচনের যৌক্তিকতা নিয়ে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণপরিষদ আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন আলাদা করে করা সম্ভব নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন করাই এ সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই গণপরিষদ নির্বাচন বা সংবিধান সংশোধন যাই করা হোক, আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়া দরকার। সে সংসদ চাইলে ১৯৭০ সালের মডেলে গণপরিষদ গঠন করতে পারে।’

এ সময়ে গণপরিষদ নির্বাচন চেয়ে সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা চলছে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যারা এই প্রস্তাব দিয়েছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমি মনে করি জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে গেলে সব কিছুই ধীরে ধীরে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই এক্ষেত্রে সবার উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা।’

বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গণপরিষদ করতে হয় যখন কোনও সংবিধান থাকে না। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে সে পরিবেশ নেই। বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা থাকলেও সংবিধান অনুযায়ীই দেশ চলছে। আর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনেও নতুন সংবিধান বা গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়নি। এটি কোনও একটি দলের দাবি থাকতে পারে। তবে তাদের চাওয়া বাস্তবায়ন করতে গেলে বিদ্যমান সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করতে হবে। তাই আমার মতে এ দাবিটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।’

এ প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তোলেনি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনেও এনসিপি ছাড়া অন্য কোনও দল এ বিষয়টি উত্থাপন করেনি। আর কমিশনও এ নিয়ে কোনও মতামত দেয়নি। কিছু বিতর্ক থাকলেও বর্তমানে সংবিধান অনুযায়ীই দেশ চলছে।’ এ দাবিকে তিনি ‘প্যান্ডেরার বাক্সের’ সঙ্গে তুলনা করেন। তার মতে, এই মুহূর্তে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবির প্রাসঙ্গিকতা নেই।

তবে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন মনে করেন, গত ৫৪ বছরেও রাষ্ট্র কাঠামোর কোনও সংস্কার হয়নি। তাই ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজাতে চান তারা। কারণ বিদ্যমান সংবিধানে সাম্য, মানবিক ও সামাজিক সুবিচারের কথা বলা হলেও সেগুলো নিশ্চিত করা হয়নি। এ জন্য আগে গণপরিষদ নির্বাচন ও সংবিধান সংশোধন করা দরকার। দাবি আদায়ে তারা প্রয়োজনে কঠোর আন্দোলনে নামবেন বলেও জানান এনসিপির এই সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক।