
দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার প্রক্রিয়ায় জোর দেয়। গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াও ছিল অগ্রাধিকারের তালিকায়। গণদাবির কারণে এই দুই ইস্যুতে গুরুত্ব দেয়ায় নির্বাচন নিয়ে সরকারের চিন্তা-ভাবনা খুব একটা প্রকাশ পায়নি। এ কারণে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। নির্বাচন কখন হবে, সরকার প্রতিশ্রুত সময়ে নির্বাচন হবে কিনা- এমন প্রশ্ন এক পর্যায়ে সরকারকেও ব্যতিব্যস্ত করে তুলে। বৈঠকে আলোচনায় রাজনৈতিক দল ও নানা পক্ষের প্রশ্নের মুখে পড়েন সরকার সংশ্লিষ্টরা। সরকারের তরফে বলা হচ্ছিল- সংস্কার ও বিচারের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পরই নির্বাচন আয়োজন করা হবে। সরকারের এমন অবস্থানে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। সরকারের এই অবস্থানের পেছনে বড় কারণ ছিল অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া কয়েকটি দল ও সংগঠনের জোরালো অবস্থান। এসব দল ও সংগঠন সংস্কার এবং বিচারকেই অগ্রাধিকারে রেখে সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছিল। পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যায় লন্ডন বৈঠকের পর।
গত ১৩ই জুন লন্ডনে হওয়া ওই বৈঠকের পর সব হিসাবনিকাশ বদলে যায়। বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণা আসে আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হয়েছে। ওই সিদ্ধান্তের পরই নির্বাচন নিয়ে তৈরি হওয়া ধোঁয়াশা কেটে যায়। নির্বাচন নিয়ে ডালপালা বিস্তার করা গুজব-গুঞ্জনের অনেকটা অবসান হয়। লন্ডনের ওই বৈঠক নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি এই বৈঠক ভালো চোখে দেখেনি। বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েও ছিল তাদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া। যদিও লন্ডন বৈঠকের পর সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। দেশে নির্বাচনের একটা আবহ তৈরি হয়। লন্ডন বৈঠকের দুই মাসেরও বেশি সময় পর জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা রোডম্যাপে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত করাসহ ২৪টি কার্যাবলীকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। ডিসেম্বরের প্রথমে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে। নির্বাচন কমিশনের এই রোডম্যাপ ঘোষণার পর থেকে নতুন করে গুজব আর গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এক ধরনের অস্থিরতাও দেখা যাচ্ছে রাজনীতির মাঠে। এর মধ্যে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা সাধারণ মানুষকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার কাকরাইলে জাতীয় পার্টির সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের জেরে নুরুল হক নুরকে পিটিয়ে আহত করার ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পরপরই গণঅধিকার সভাপতি নুরের উপর এই হামলা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচনকে পেছানো বা ব্যাহত করার কোনো পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এমনটা করা হয়েছে কিনা- এ প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। নুরের ওপর হামলার ঘটনার পরপরই কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের সঙ্গে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরির পেছনেও কোনো পক্ষের ইন্ধন থাকতে পারে বলে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় জোবরা গ্রামের মানুষের রক্তাক্ত সংঘর্ষের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখারও দাবি উঠেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়েও শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরেও ক্ষণে ক্ষণে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। গতকাল নির্বাচন স্থগিত করে উচ্চ আদালতের আদেশ এবং পরে চেম্বার আদালতে তা স্থগিতের খবরে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। নাটকীয় এই রায়ে শিক্ষার্থীদের মাঝেও ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়। যদিও চেম্বার আদালতের রায়ে পরিস্থিতি আর ঘোলাটে হয়নি। রোববার খবর রটে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু কোনো সূত্রই ওই বৈঠকের বিষয় নিশ্চিত করতে পারেনি। ওই বৈঠকের এমন খবর ছড়ানোর পর একটি পক্ষ নতুন করে নানা গুজব ছড়াতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হয় নানা অপতথ্য। গতকাল সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতের পর তিনি ও প্রধান উপদেষ্টার তরফে নির্বাচন বিষয়ে একই ধরনের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়। সেনাপ্রধান গুজব নিয়েও দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন। গুজবের প্রতি মনোযোগ না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পুরো সেনাবাহিনী সরকারের সব উদ্যোগ ও কর্মসূচি সফল করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যথাসময়ে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সরকার শক্ত অবস্থানে রয়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টার তরফে বলা হয়।
ওদিকে গতকাল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, সরকারের ঘোষিত সময় অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা জানান। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে কোনো আলোচনা নেই বলেও জানিয়েছেন ড. আসিফ নজরুল।
সরকারের পক্ষ থেকে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলেও নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের বড় কারণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া কয়েকটি পক্ষের অবস্থান। জামায়াতের পক্ষ থেকে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করা হচ্ছে। এ ছাড়া জুলাই সনদ নিয়েও দলটির নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। অন্যদিকে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির অবস্থানও ভিন্ন। দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে- আগে গণপরিষদ নির্বাচন করে নতুন করে সংবিধান পরিবর্তনের। নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত দলটির স্পষ্ট অবস্থান নেই। জামায়াতের সঙ্গে আরও কয়েকটি ইসলামী দল একই অবস্থান ও দাবি ব্যক্ত করে আসছে। অন্যদিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সরকার ঘোষিত সময়ে নির্বাচন করার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছে। নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের দুই অবস্থানের কারণে অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সমর্থিত পক্ষগুলো নানা গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া জামায়াত-এনসিপিসহ কয়েকটি দল ও পক্ষ নির্বাচন বিলম্ব হলে নিজেদের সুবিধা দেখছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে।
এমন অবস্থায় সর্বশেষ রোববার তিনটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি’র সঙ্গে ওই বৈঠকের পর সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন ইস্যুতে স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে। বিএনপিও আশ্বস্ত হয়েছে নির্ধারিত সময়ে সরকার নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু জামায়াত এবং এনসিপি ভিন্ন অবস্থান জানিয়েছে। জামায়াতের তরফে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে, সরকার যে অবস্থায় আছে তাতে তাদের পক্ষে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে কিনা। এনসিপি আগের মতোই গণপরিষদের দাবি তুলেছে। এই দুই দলের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হয়েছে।
জাপা ও গণঅধিকার পরিষদ নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও নুরের ওপর হামলার ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় জাতীয় পার্টি। বলা হচ্ছে জাতীয় পার্টিকে অদৃশ্য শক্তি সামনে আনতে চাইছে। জাপার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে দাঁড় করার চেষ্টা আছে বলেও কেউ কেউ বলছেন। এমন আলোচনা অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে অবশ্য ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। এ কারণে জাপাকে নিষিদ্ধ করা এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে দলটির নেতাদের বিচারের দাবিও জানানো হচ্ছে।
চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে বিএনপি’র পক্ষ থেকেও। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রোববার এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে অথবা জটিল করে তোলা হচ্ছে। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আমাদের রাজপথের সহযোদ্ধা নুরুল হক নুরের ওপর হামলাসহ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা স্পষ্ট, দেশের স্থিতিশীল পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে বলেও মন্তব্য করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটছে, তখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তাদের দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নানা শর্ত আরোপ করছে। এই শর্ত আরোপ করে নির্বাচনের পথে হয়তোবা পরিকল্পিত উপায় বাধার সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে বলে বহু মানুষ এরই ভেতরে ভাবতে শুরু করেছেন।
গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও নির্বাচন নিয়ে নিজেদের চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছেন। নির্বাচন আয়োজনে গুজব ছড়ানো ও সংশয় তৈরি হওয়ার বড় একটি কারণ দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মবের ঘটনা। গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসিরউদ্দিন এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি এন জ্যাকবসনের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন। এর জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের নির্বাচন একসঙ্গে হবে। তখন ওই ৩০০ জায়গাতেই ‘মব’ ভাগ হয়ে যাবে। যারা মব সৃষ্টি করেন তারা নিজ নিজ এলাকায় চলে যাবেন। তখন একসঙ্গে এত লোক একত্রে আর পাওয়া যাবে না। যারা মব সৃষ্টি করতে চায়, বা মব সৃষ্টি করবে, তারা নির্বাচনের সময় সুবিধা করতে পারবে না। সিইসি’র এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে আসছে নির্বাচনের সময়ও মবের ঘটনা হয়তো ঘটতে থাকবে। এর মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে।