
দেশে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তিন দফা দাবিতে আন্দোলনের মাঠে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অস্থিরতা।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন এক সময় এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যখন আগামী ফেব্রুয়ারির প্রধমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে রোডম্যাপও প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। আবার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে যাচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত শনিবার রাত থেকে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে বহু শিক্ষার্থী আহত হয়। গতকাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও (বাকৃবি) বহিরাগতদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়।
তিন দফা দাবিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেছেন। দাবি আদায়ে এখনো তাঁরা আন্দোলনের মাঠে রয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে চলছে আন্দোলন।
সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পর স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা দাবিতে প্রায়ই রাস্তায় নামছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে তাঁরা ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে এবং সমস্যার সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। গত রবিবার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয়ে একটি সভা হয়েছে। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষার্থী, স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে এই কমিটি কাজ করবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে বলা হয়, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের প্রস্তাব পাঠানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) নির্দেশ দিয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়।
ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যে সমস্যা চলছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত প্রশাসনিক বিষয়। তবে সামনে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন, রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়েছে, এখন সব পক্ষকে একসঙ্গে বসে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন গত রবিবার তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আর কী কী প্রমাণ পেলে নিশ্চিত হবেন যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠেনি? ৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী চারটির মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা দেখুন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমস্যার মূল কারণ হল যোগ্য শিক্ষক ও প্রশাসকের অভাব।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন রাজনৈতিক খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। সবাই সারাক্ষণ শুধু রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ব্যস্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠেয় হতে যাওয়া ডাকসু নির্বাচন এখন পুরো দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এই নির্বাচনে শুধু একটি বা দুটি প্যানেল সম্ভবত লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বাইরে। বাকিরা সবাই জাতীয় নির্বাচনের প্রিটেস্ট খেলছে। চিটাগং বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তারক্তির ঘটনা সবাই জানে। রাজশাহীর রাকসুও উত্তেজনায় রয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও অনুরূপ পরিস্থিতি হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয় ও বহিরাগতদের হামলা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে কমিশনারের কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনায় উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফোরাম (ইউটিএফ)। গতকাল সোমবার ইউটিএফের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম এক বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানান।
হামলাসমূহের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ওপর এ ধরনের বর্বরোচিত হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক এবং শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশের জন্য হুমকি। আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ হামলার ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ হামলার ঘটনায় বহিরাগত স্থানীয়দের পাশাপাশি অন্য কোনো সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী জড়িত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয় সন্ত্রাসী কর্তৃক হামলার প্রতিবাদে গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন ঢাকার সাবেক চবিয়ান সংগঠন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ আলম বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে আজ অস্থিতিশীল করা হচ্ছে। আমার ছাত্রদের ওপর, আমাদের সহকর্মীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। আমি বলতে চাই, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যদি অশান্ত হয়ে যায়, তাহলে সমগ্র বাংলাদেশেও অশান্তি ছড়িয়ে পড়বে।’
জানা যায়, গত শনিবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে গতকাল রবিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত দফায় দফায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসংলগ্ন জোবরা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের অন্তত ২২০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের প্রায় ২০০ জনই শিক্ষার্থী। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে দুই পক্ষকেই সরিয়ে দেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারাও জারি করা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবিতে দুটি অনুষদের শিক্ষার্থীরা গত রবিবার দিনভর শিক্ষকদের অবরোধ করে রাখার পর সন্ধ্যায় বহিরাগতরা এসে হামলা করে। দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাত সাড়ে ৯টায় একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ছয় দফা দাবিতে গতকাল রেলপথও অবরোধ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা।