Image description
১১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান * শতাধিক মানুষকে ভুয়া ভিসা প্রদান

ইতালি পাঠানোর কথা বলে শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রাজশাহীর একটি শিক্ষক পরিবার। বিনিময়ে দিয়েছে ভুয়া ভিসা। বেশকিছু অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া ভুক্তভোগীদের পাসপোর্ট আটকে রেখেছে প্রতারক চক্রটি। রাজশাহী, চাঁপাইানবাবগঞ্জ, ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় এদের নেটওয়ার্ক রয়েছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতারক পরিবারের চার সদস্য হলেন-রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ কাশিয়াডাঙা থানার সাইরগাছা মহল্লার সুফিয়া খাতুন, তার স্বামী মারুফ উদ্দিন আহমেদ, তাদের মেয়ে ফারিহা আহমেদ এবং ফারিহার স্বামী হাবিবুর রহমান। চক্রের প্রধান সুফিয়া জেলার পবা উপজেলার শিতলাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।

ইতালি পাঠানোর কথা বলে সুফিয়া ও তার পরিবারের সদস্যরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিন উপজেলার ২১ জনের কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা নিয়েছেন। এ ঘটনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বাসিন্দা এবং বর্তমানে রাজশাহী মহানগরীর কাশিয়াডাঙায় বসবাসরত মিজানুর রহমান প্রতারিতদের পক্ষে বৈদেশিক কর্মসংস্থান অভিবাসী আইনে ২৯ জুলাই আদালতে পরিবারটির চার সদস্যসহ অজ্ঞাত ১২ ব্যক্তির নামে অভিযোগ দিয়েছেন। আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে ৩ আগস্ট কাশিয়াডাঙা থানাকে এফআইআর হিসাবে গণ্য করার নির্দেশ দেন। মামলার পর ১০ আগস্ট দুই আসামি সুফিয়া খাতুন এবং তার স্বামী মারুফ উদ্দিন আহমেদ আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাদের জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। ১৩ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাশিয়াডাঙা থানার এসআই নূর মোহাম্মদ আদালতে দুই আসামির ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান। আদালত ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

তদন্ত কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, রিমান্ডে আসামি দম্পতি কিছুই স্বীকার করেননি। তবে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর কাগজপত্র পেয়েছি। সেখানে অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের নাম রয়েছে। এ ক্লু ধরে তদন্তের মাধ্যমে চক্রটির অন্য সদস্যদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। আর তাদের মেয়ে ও জামাই দুবাইয়ে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এর সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে। তারা যদি দেশেই আত্মগোপন করে থাকেন, তাহলে তাদের গ্রেফতার করা হবে। এ জন্য আমরা সোর্স লাগিয়েছি।

মামলার এজাহারে বাদী মিজানুর রহমান উল্লেখ করেন, পাশাপাশি বসবাসের কারণে এক নম্বর আসামি সুফিয়া খাতুনের পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয়। দীর্ঘ সময় চলাফেরায় ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এক সময় সুফিয়া খাতুন জানান, তার মেয়ে ও জামাই দুবাইয়ে বসবাস করেন। সেখানকার অনেক বড় ব্যক্তিদের সঙ্গে ওদের পরিচয় রয়েছে। ওরা বিদেশে লোক পাঠাতে পারেন। সুফিয়ার কথাতে আমি রাজি হয়ে আমার পরিচিত ২১ ব্যক্তিকে ইতালিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেই। এরপর সুফিয়া তার মেয়ে ও জামাইকে ভিডিও কল করেন। তারা ইতালিতে নিয়ে যেতে পারবেন বলে জানান।

এ ঘটনার পর সুফিয়া এবং তার স্বামী মারুফকে আমরা নগদ এক লাখ টাকা দেই। পরে সুফিয়া বলেন, আমার মেয়ে ও জামাই যখন যে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে বলবেন, সে নম্বরে পাঠাবেন। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আমাদের ২১ জনের কাছ থেকে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে তারা দেড় কোটি টাকা নেন। সর্বশেষ গত বছরের ১৮ অক্টোবর ইতালি যাওয়ার ভিসা দেখিয়ে আমাদের কাছে আরও ৫০ লাখ টাকা চান। আমরা নগদে এ টাকা প্রদান করি। এভাবে সর্বমোট এক কোটি ৯০ লাখ ৯৮ হাজার ৫১৫ টাকা প্রদান করা হয়। একপর্যায়ে আমরা প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে টাকা ফেরত চাই। টাকা না দিয়ে চক্রটি আমাদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়।

মিজানুর রহমান বলেন, পরিবারটির চার সদস্যই প্রতারক। তারা দুবাইয়ের নম্বর ব্যবহার করে আমাদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলে কথা বলেছেন। সুফিয়ার মেয়ে ফারিয়ার শ্বশুরপক্ষের নিকটাত্মীয়রা দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে আছেন বলে মিথ্যা গল্প সাজিয়েছেন। মাঝে মাঝে এরকম দু-একজনের সঙ্গে আমাদের কথা বলিয়েছেন। এভাবেই তারা আমাদের আস্থা অর্জন করেন।

তিনি বলেন, ডাচ্-বাংলা, ব্যাংক এশিয়া এবং আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের মোট ১১টি অ্যাকাউন্টে দীর্ঘ সময় ধরে তারা টাকা নেন। এর মধ্যে ডাচ্-বাংলার অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের সংখ্যা বেশি। এগুলো ডাচ্-বাংলার চট্টগ্রামের রাউজান, বাঁশখালি, পাথেরহাট ও ফটিকছড়ি শাখার অ্যাকাউন্ট। টাকা পাঠানোর সব প্রমাণাদি আমাদের কাছে রয়েছে। অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের নামের সূত্র ধরে তদন্ত করলেই এ চক্রের সঙ্গে আরও কারা জড়িত সেটি বের করা সম্ভব হবে।

এছাড়া সাদি আহমেদ সুমন নামে ঢাকায় বেসরকারি একটি সংস্থায় কর্মরত এক ব্যক্তির সঙ্গেও প্রতারণা করেছে চক্রটি। তার পরিবারের নয়জন এবং নিকটাত্মীয়সহ ১৩ জনের কাছ থেকে গত বছরের বিভিন্ন সময়ে অন্তত এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। ইতালি যাওয়ার ভুয়া ভিসা দিলে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন সুমন এবং তার পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া শরীয়তপুরের ইসাহাক এবং চাঁদপুরের সোহেলের সঙ্গেও চক্রটি প্রতারণা করেছে।

সুমন বলেন, চাকরির সুবাদে ২০২৩ সালে আমি রাজশাহীতে আসি। এ সময় ফারিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তারা আমাদের নানা প্রলোভনে ব্রেন ওয়াশের মাধ্যমে প্রতারিত করেছে। মিজানুর রহমান, ইসাহাক, সোহেল এবং আমি ছাড়াও আরও অন্তত ৫০ জানের কাছ থেকে চক্রটি টাকা নিয়েছে। সবমিলিয়ে হাতিয়ে নেওয়া টাকার পরিমাণ আনুমানিক পাঁচ কোটি হবে।

প্রতারিত কুরবান আলী (চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের বাসিন্দা) বলেন, ফারিহা ও তার স্বামী দুবাইয়ে থাকেন না। আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য এ ধরনের গল্প সাজানো হয়েছে। মামলা হওয়ার পর সুফিয়া ও তার স্বামী মারুফ জেলহাজতে আছে। তবে ফারিহা ও হাবিবুর তাদের ব্যবহৃত ফোন নম্বর, ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তারা দুবাইয়ে নেই। দেশের যে কোনো স্থানে আত্মগোপন করে আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্যোগী হলেই তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব।

সুফিয়া খাতুনের জেলে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শিতলাই প্রাথমিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা ফেরদৌসি বেগম বলেন, ‘সুফিয়া খাতুন ১ আগস্ট থেকে স্কুলে অনুপস্থিত। বিষয়টি সম্পর্কে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।’

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার একেএম আনোয়ার হোসেন বলেন, সুফিয়া খাতুন প্রতারণা মামলায় জেলে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মামলাসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আমরা পেয়েছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।