
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ বহির্ভূত তিনটি পৃথক খাত দেখিয়ে প্রায় ৫৮৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা অপচয় ও আত্মসাতের অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গতকাল দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের বাইরে অসৎ উদ্দেশ্যে ‘পরিষেবা এলাকা’, ‘পর্যবেক্ষণ সফটওয়্যার’ এবং ‘একটি টাগবোট’ এই তিনটি পৃথক খাত দেখিয়ে ৫৯ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় ৫৮৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা আত্মসাত, অপচয় ও রাষ্ট্রীয় তহবিলের ক্ষতিসাধন করায় তৎকালীন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ চারজনের বিরুদ্ধে দুদক এই অভিযোগ গঠন করেছে।
মামলার অপর তিন আসামি হলেন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক (পরবর্তীতে মন্ত্রী পরিষদ সচিব) খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমদ, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সাবেক পরিচালক (অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব পরিচিতি-৩৬৪২) আলীম উদ্দিন আহমেদ।
কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ২০১০ সালে যে কল্পনাপ্রসূত উদ্দেশ্য বর্ণনা করে কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ করা হয়েছিল। তিনি এই টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়কে এখন ‘সরকারের কাছে গলার কাঁটা’ বলে মন্তব্য করেছেন। ‘কর্ণফুলী টানেল হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চাভিলাষ প্রকল্প। যাকে ‘চৌবাচ্চায় হাঙ্গর লালনের সঙ্গে তুলনা করা যায়’। বছরের পর বছর রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বহন করে যেতে হচ্ছে। টানেল ব্যবহার জনস্বার্থ রক্ষা ও আয়বর্ধক না হলে এই টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বছরের পর বছর টানতে হবে রাষ্ট্রকে। কারণ কর্ণফুলী টানেলের যেকোনো ক্ষতির সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী মোহনার সরাসরি সম্পৃক্ত। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের পর প্রতি মাসে রক্ষণাবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে ৯ কোটি ৩৫ লাখ ৭১ হাজার ৭১ টাকা খরচ করতে হয়।
সেই হিসাবে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০২৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ২২ মাসে টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ, বেতনভাতাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে খরচ হয়েছে ২০৫ কোটি ৮৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫৬১ টাকা। পক্ষান্তরে উপরোক্ত ২২ মাসে টানেলের ভেতর দিয়ে যানবাহন চলাচলে আয় হয়েছে ৬৭ কোটি ২৫ লাখ ৫৪ হাজার ১০০ টাকা।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, টানেল উদ্বোধনের পর প্রতি মাসে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৩০ লাখ ৪৩০ টাকা। অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ২২ মাসে টানেলের পেছনে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩৮ কোটি ৬০ লাখ ৯ হাজার ৪৬১ টাকা।
দুদক সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের জন্য মূল ডিপিপি ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালে রিভাইজড ডিপিপিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালে তা সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকায় বৃদ্ধি করে প্রকল্পের ব্যয় প্রস্তাবনা অনুমোদন করা হয়।
টানেলের সম্ভাব্যতা যাছাই করার ট্রাফিক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হলে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রাকগুলোকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহার করতে উৎসাহিত করবে এই টানেল। অথচ দেখা যায়, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হয়নি। প্রস্তাবিত টানেলটি কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে অবস্থিত প্রস্তাবিত শিল্পাঞ্চলের জন্য কাজ করবে বলা হলেও আজ পর্যন্ত একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেনি। বরং তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা টানেল অনুমোদন হবার আগেই সম্ভাব্য প্রকল্প এলাকার জমি কম মূল্যে কিনে প্রকল্পের কাছে বেশি মূল্যে বিক্রি করে আর্থিক ফায়দা লুটে নিয়েছে।