
সাদাপাথর লুটের ঘটনার সময় সিলেটের আরেকটি কোয়ারির পাথর লুটের ঘটনা আলোচনায় এসেছিল। সেটি হচ্ছে জৈন্তাপুরের রাংপানি ও শ্রীপুর পাথর কোয়ারি। পাথরখেকোরা ওই কোয়ারির শূন্যরেখা থেকে পাথর লুট করেছে। অন্তত ২৫-৩০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এই কোয়ারির এক সময়ের নিয়ন্ত্রক ছিলেন জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রাজা। ৫ই আগস্টের পর এলাকা ছাড়া হলেও কৌশলে এখনো রাজার রাজত্বেই চলছে কোয়ারি লুটপাট। এক্ষেত্রে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন রাজার দুলাভাই উপজেলা বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল আহাদ। অভিযোগ উঠেছে; দুলাভাইকে দিয়ে রাজা রাংপানি ও শ্রীপুরে দাপট দেখাচ্ছেন। গণ-অভ্যুত্থানের আগে রাংপানি ও শ্রীপুর কোয়ারিতে ভয়ে কেউ যেতে পারেননি। পরিবেশবিদ, আইনজীবী ও সাংবাদিকরা গেলে প্রকাশ্যেই চোখ রাঙাতো রাজার বাহিনী। এমনকি হামলা করতে উদ্যত হতো।
এ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও রাজার নিয়ন্ত্রিত ওই এলাকায় রাজাই ছিলেন একক রাজা। পট পরিবর্তনের পর রাজা নিজের বোনজামাইকে ব্যবহার করছেন বলে স্থানীয় বিএনপি’র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। দেড় মাস আগে ইউনিয়ন বিএনপি’র তরফ থেকে জেলা বিএনপি’র কাছে আব্দুল আহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। এই অভিযোগে তারা রাজার অপকর্মের সঙ্গে সর্ম্পক এবং পরবর্তীতে শ্রীপুর ও রাংপানিতে লুটপাটের অভিযোগ করা হয়েছে। এবার আগস্টের প্রথমার্ধ্বে রাংপানিতে লুট করা হয়েছে। এই লুটের সঙ্গে রাজা ও আব্দুল আহাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এলাকায় চাউর হয়েছে। তাদের সঙ্গে শ্রীপুর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলদার আহমদ, বাংলাবাজার ঘাটের বালু ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রফিক আহমদ, ২নং জৈন্তাপুর ইউপি’র জামায়াত নেতা নুরুল ইসলাম ও উপজেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি আলমগীর হোসেনের নামও আলোচনায় আসে। মুলত সর্বদলীয় নেতৃত্বেই এবার রাংপানি ও শ্রীপুর লুট হয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার সক্রিয় হয় জৈন্তাপুরের উপজেলা প্রশাসন। পাথর উদ্ধারে তারা প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছে। অভিযান থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে রাংপানি ও শ্রীপুর থেকে উত্তোলিত পাথর।
জৈন্তাপুরের ইউএনও জর্জ মিত্র চাকমা মানবজমিনকে জানান- শ্রীপুর ও রাংপানি থেকে লুট হওয়া প্রায় ৪০ হাজার ফুট পাথর ইতিমধ্যে বিভিন্ন ক্রাশার মিল ও পরিত্যক্ত এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো এখন প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। সর্বশেষ বুধবার অভিযান চালিয়ে পাথর জিম্মায় থাকা একজনকে এক মাসের দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি নেতা আলমগীর হোসেনের নাম। তিনি মানবজমিনকে জানান- এই লুটে তিনি জড়িত নন। যারা ওই এলাকার ব্যবসায়ী ও শ্রমিক- তারাই লুটের সময় কর্তৃত্ব খাটিয়েছে। তিনি কোনোদিনই কোয়ারিতে যাননি। তবে লুটের কিছু কিছু মাল তার কর্মচারীরা কিনেছিলেন বলে স্বীকার করেন তিনি। বলেন, কোয়ারিতে কারা লুটপাট করেছে- সেটি দিবালোকের মতো সত্য। এ ব্যাপারে মাসখানেক আগে স্থানীয় বিএনপি’র পক্ষ থেকে জেলা বিএনপি’র কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। এই অভিযোগে তার স্বাক্ষর ছিল। এ কারণে এখন তাকে লুটপাটকারী সাজানো হচ্ছে। ইউনিয়ন জামায়াত নেতা নুরুল ইসলামও লুটের ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমি ব্যবসায়ী নই। অপপ্রচার চালিয়ে আমাকে হেয় করা হচ্ছে
তবে; কোয়ারির বাংলাদেশ অংশ থেকে নয়, নো-ম্যান্স ল্যান্ডের ভারতীয় অংশ থেকে পাথর লুটপাট করা হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন বলে জানান। ৪নং বাংলাবাজার বালু ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রফিক আহমদ জানান, তিনি এখন আর সমিতির সভাপতি নন। এ কারণে তিনি রাংপানি কিংবা শ্রীপুরে যান না। কয়েক মাস আগে জৈন্তাপুরের এসিল্যান্ড গিয়ে ঘাট বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে ঘাটেও যান না। তবে এবার শ্রমিকরা লুটপাট চালিয়েছে বলে জানান তিনি। শ্রীপুর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলদার আহমদ জানান, তিনি মুলত তামাবিলের এলসি ব্যবসায়ী। ওখানে এসে কৌতূহলবশত নির্বাচন করায় পাস করেছেন। পাথর লুটে তিনি সম্পৃক্ত নন। যারা পাথর লুট করেছে তারা বিজিবি-বিএসএফ’র গুলির মুখে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় লুট করেছে। এখন প্রশাসন অ্যাকশনে নামায় পাথর কোয়ারিতে ফিরছে। এতে ব্যবসায়ীরা সহযোগিতা করছেন বলে জানান তিনি। এদিকে, পাথর লুটপাট ও রাজার সঙ্গে সম্পর্ক্যের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জৈন্তাপুর উপজেলা বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল আহাদ। তিনি বলেন, এলাকার গরিব মানুষ ও শ্রমিকরা মিলে পাথর লুট করেছে। সেখানে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
৫ই আগস্টের পর পাথর লুটেরাদের বাধা দিয়ে তিনি শ্রীপুর ও রাংপানি লুট থেকে রক্ষা করেন। এরপর থেকে তাকে নানাভাবে আক্রমন করা হচ্ছে। জেলা বিএনপি ইতিমধ্যে তদন্ত করে তার কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি। তিনি আরও বলেন, আত্মীয় হলেও রাজার সঙ্গে বিগত ১৭ বছর তার কোনো সম্পর্ক ছিল না- এখনো নেই। যারা এখন রাজার দোহাই দিয়ে আমাকে বিতর্কিত করছেন তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য করছেন। এ ব্যাপারে জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রাজা মানবজমিনকে জানান, তিনি তো গত বছরের ৫ই আগস্ট থেকে এলাকায় নেই। এখন তার বিরুদ্ধে পুরনো আক্রোশে এই অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তিনি ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। খুব কম ভোটে পরাজিত হওয়ার পর তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল এই অপপ্রচার চালাচ্ছে। পাথর লুটে কারা জড়িত সেটি প্রশাসন থেকে নিরপেক্ষ তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। এ ব্যাপারে তিনি নিজেও প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন।