
গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫ নামের একটি নতুন আইনের খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। খসড়াটির নিয়ে আরো যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নতুন আইনের খসড়াটিতে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।
বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানান। এসময় প্রেস উইংয়ের অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
প্রেস সচিব বলেন, গুম একটি গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের জন্য সরকার একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আইন মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা পরিষদে গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫ নামের একটি নতুন আইনের খসড়া উপস্থাপন করে। আইনের খসড়ার ওপর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা দীর্ঘসময় ধরে আলোচনা করেন। আইনটি কার্যকর করার বিষয়ে সদস্যরা কিছু পরামর্শ ও প্রস্তাবনা দিয়েছেন। এগুলোকে অর্ন্তভূক্ত করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় আবারও উপদেষ্টা পরিষদের এটি উপস্থাপন করবে।
প্রেস সচিব বলেন, ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এ দিবসটি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করবে।
প্রস্তাবিত আইনটি কার্যকর হলে গুমের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। এতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হলে মৃত্যুদণ্ডসহ সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এ আইনে। ১২০ দিনে মামলার বিচার নিষ্পত্তি করতে হবে ট্রাইব্যুনালকে।
প্রস্তাবিত আইনের বিষয়ে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল আমার দেশকে বলেন, ‘গুমের বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বদ্ধপরিকর। আমাদের সরকার গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ২১ দিনের মাথায় (২৯ আগস্ট) আন্তর্জাতিক গুম কনভেনশনে স্বাক্ষর করে এর অংশীদার হয়েছে।
বিগত আমলে গুমের যত ঘটনা ঘটেছে, সে-বিষয়ে তদন্তের জন্য আমরা সরকার গঠনের পরপরই গুম ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করেছি। ওই কমিশন ইতিমধ্যে প্রায় দুই হাজার গুমের অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে, আগামী ডিসেম্বরে তারা কাজ শেষ করবেন। আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে ওই ট্রাইব্যুনালে পরিকল্পিত ও ব্যাপক গুমের ঘটনাগুলোর বিচার করার ব্যবস্থা করেছি। বর্তমানে প্রায় একশটি গুমের অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সীমাবদ্ধতা হলো এই ট্রাইব্যুনাল আইনত সব ধরনের গুমের বিচার করতে পারে না। এটি কেবল ব্যাপক ও পরিকল্পিত পদ্ধতিতে সংঘটিত গুমের বিচার করতে পারে। মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত যেসব গুম হয়েছে, সেগুলোর বিচারের জন্য আমাদেরকে পৃথক আইন ও ট্রাইব্যুনাল করতে হচ্ছে। আমরা সেই কাজ প্রায় সম্পন্ন করেছি।’
গুম কমিশন ও ব্লাস্টসহ কয়েকটি সংগঠন ও সংস্থা গুমের বিচারে আইন প্রণয়নসহ কিছু সুপারিশ করেছে। আইন মন্ত্রণালয়ও সেমিনারের মাধ্যমে মতামত নিয়েছে।
সরকার নতুন আইনের বিষয়ে কী উদ্যোগ নিয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আইনের শিক্ষক আসিফ নজরুল জানান, গুমকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য তার বিচারের জন্য আমরা আইন মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে ‘গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছি। এই খসড়া তৈরির ক্ষেত্রে গুম ইনকোয়ারি কমিশন, ব্লাস্ট, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে এবং গুরুত্বের সঙ্গে তাদের মতামত আইনে প্রতিফলন করা হয়েছে। এই আইনে গুমের অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, গুমের বিচার নিশ্চিত করার জন্য পৃথক তদন্ত দল, পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে, গুমের ভুক্তভোগীদের জন্য ক্ষতিপূরণসহ পৃথক তহবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে, গুম হওয়া ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে গুম হওয়া ব্যক্তির নির্ভরশীল সদস্যরা যেন ভরণপোষণ পেতে পারেন, তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার বিধান করা হয়েছে। আশা করছি, কিছুদিনের মধ্যেই আইনটি কার্যকর করে গুমের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।’
প্রস্তাবিত আইনে শেখ হাসিনার আমলে আয়নাঘরসহ বিভিন্নভাবে গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিচার পাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ থাকছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, যে আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করে এই আইনটি তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে গুমকে ‘চলমান অপরাধ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। চলমান অপরাধ হওয়ার ফলে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন না হওয়া পর্যন্ত গুম অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ফলে এই আইন কার্যকর হওয়ার আগে যত গুমের ঘটনা ঘটেছে, সব ঘটনার বিচার এই আইনের অধীনে করা সম্ভব হবে। বিগত আমলে যারা আয়নাঘরসহ নানাভাবে গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের সবাই এই আইনের আওতায় বিচার পাবেন।