Image description

ঢাকায় আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর প্রকাশকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ভারতীয় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। অনেকটা গোপনীয়তা রক্ষা করে অনুষ্ঠিত দুদিনের বৈঠকটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে নানা গুঞ্জন ও শঙ্কা বিরাজ করছে। গত ৬ আগস্ট রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে দিল্লিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘এএসএপি গ্লোবাল ই-বুকস প্রাইভেট লিমিটেড’ বৈঠকটির আয়োজন করে। ‘কোলাবরেট অন ই-বুক রাইটস’ শীর্ষক ওই বৈঠকে শুধু আওয়ামী ঘরানার বা তাদের সুবিধাভোগী প্রকাশকরাই উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। এছাড়া এএসএপির কর্মকর্তা পুনিত মিন্দাসহ কয়েকজন সেখানে ছিলেন। পরবর্তীতে আরো বড় পরিসরে এ ধরনের বৈঠক হবে বলে সংশ্লিষ্টদের আভাস দেওয়া হয়েছে।

সূত্রমতে, এ বৈঠকের খবর দেশের সাধারণ প্রকাশকদের কেউ জানতেন না। অথচ ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী গা-ঢাকা দেওয়া প্রকাশকদের অনেককেই ওই মিটিংয়ে দেখা গেছে। তারা সেখানে বক্তব্যও রাখেন। ভারতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ ধরনের গোপন মিটিংয়ের মাধ্যমে দেশবিরোধী নতুন কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না, তা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী প্রকাশকরা।

সূত্রমতে, ই-বুক ব্যবসা বিষয়ে আলোচনার জন্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি এ দেশের ৬০ প্রকাশককে আমন্ত্রণ জানায়। প্রথম দিনের বৈঠকে ৩৪ জন উপস্থিত ছিলেন। পরদিন আরো কয়েকজনকে নিয়ে বৈঠক হয় তাদের। দুদিন ধরে এসব বৈঠক হলেও বাংলাবাজারের সাধারণ প্রকাশকরা জানতে পেরেছেন আরো কদিন পর। সংশ্লিষ্ট মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারীদের একটি গ্রুপ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।

ওই মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি প্রকাশকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাজহারুল ইসলাম (অন্যপ্রকাশ), ফরিদ আহমেদ (সময় প্রকাশন), মিলন কান্তি নাথ (অনুপম প্রকাশনী), আবুল বাশার ফিরোজ শেখ (ধ্রুবপদ), নেসারউদ্দিন আয়ুব (মাতৃভাষা প্রকাশ), মো. জসিম উদ্দিন (কথাপ্রকাশ), মো. সাহাদাত হোসেন (অন্বেষা প্রকাশন), হুমায়ুন কবীর (চারুলিপি প্রকাশন), এ কে নাছির আহমেদ সেলিম (কাকলী প্রকাশনী), মো. তোফাজ্জল হোসেন (বিশ্বসাহিত্য ভবন), কমলকান্তি দাস (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ), শামীমা শাহীন (চন্দ্রদ্বীপ প্রকাশনী), প্রতীক হোসেন (প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা), আবু মুসা খান (হাতেখড়ি), দেওয়ান আজিজ (পঙ্খিরাজ প্রকাশনী), আমিন খান (অক্ষর প্রকাশনী), মো. আবু তাহের (হাতেখড়ি), ফারুক (মাওলা ব্রাদার্স) প্রমুখ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পতিত আওয়ামী সরকার, শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার নামে শত শত বই প্রকাশ করে একেকজন আওয়ামী প্রকাশক কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছে। শুধু বই প্রকাশই নয়, নগ্ন দালালিতেও মগ্ন ছিল দেশের বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এ সময় সংশ্লিষ্টদের প্রকাশিত বিভিন্ন বই-ই তার প্রমাণ। চব্বিশের বিপ্লবের বিরুদ্ধেও অনেকে নানাভাবে লেখালেখি করেন। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর সেসব প্রকাশকের অনেকে গা-ঢাকা দেন। দীর্ঘদিন পর তাদের দেখা মেলে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গোপন বৈঠকে। এতে সাধারণ প্রকাশকদের মাঝে নতুন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি সাঈদ বারী আমার দেশকে জানান, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পক্ষের বা দালালদের নিয়ে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের মিটিং নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। ভারত যেখানে বাংলাদেশিদের মেডিকেল ভিসাও দিচ্ছে না, বৈরী মনোভাব প্রকাশ করছেÑসেখানে আওয়ামীপন্থি প্রকাশকদের সঙ্গে কী এমন ব্যবসায়িক মিটিং থাকতে পারে?

তিনি বলেন, আমরা বৈষম্যবিরোধী সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি যে, ওই গোপন মিটিংয়ের বিষয়ে ভালোভাবে তদন্ত করা হোক। বর্তমান সরকার ও দেশবিরোধী নতুন কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, রাজনৈতিক কোনো ষড়যন্ত্র চলছে কি নাÑএটা খতিয়ে দেখতে হবে।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী চারুলিপি প্রকাশনের হুমায়ুন কবীর আমার দেশকে জানান, অনলাইনে পিডিএফ বই বিক্রির বিষয়ে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির আমন্ত্রণে আমরা ব্যবসায়িক মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলাম। আয়োজকরা প্রথমে ই-মেইলে ৬০ জনকে ইনভাইট করে। পরে হোয়াটসঅ্যাপ মোবাইলে যোগাযোগ করে উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করে।

তিনি বলেন, দুদিনের ওই মিটিংয়ের প্রথম দিনে আমিসহ ৩৪ জন উপস্থিত ছিলাম। অথচ ২০ জনের একটি ছবি প্রকাশ করে যেসব অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে, তা ঠিক নয়। কারণ, পরদিন পাঞ্জেরী প্রকাশনীসহ আরো অনেকের সঙ্গে মিটিং ও ডিনার হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন দল-মতের লোক ছিলেন।

এক প্রশ্নের জবাবে হুমায়ুন কবীর বলেন, ব্যবসায়িক বিষয়ে আয়োজকরা যাদের পছন্দ করেছেন, তাদেরকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সবাই ওই বৈঠকের খবর জানবে কেন? আমরা তাদের চিনিও না। অনলাইনে বই বিক্রির বিষয়ে মিটিং হতেই পারে। তবে তারা প্রত্যেক প্রকাশককে ৫-১০টি বই পিডিএফ করে অন্য কোথাও কপি না দেওয়ার শর্ত দিয়েছে। আমরা এতে রাজি হইনি। মিটিংটিতে ব্যবসায়িক উদ্যোগ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না বা থাকলেও আমার জানা নেই। তবে সেখানে গোয়েন্দা সংস্থার লোকের উপস্থিতি ছিল বিধায় বিষয়টি সরকারের জানা আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অনুপম প্রকাশনীর মিলন কান্তি নাথ বলেন, ই-বুক ব্যবসা-সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য ভারতীয় কোম্পানিটি একজন প্রকাশক হিসেবে বৈঠকে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বাংলাদেশে তাদের পক্ষ থেকে ‘শাহজাহান’ নামের একজন সমন্বয় করেন। আমি এর আগে ওই কোম্পানির নাম জানতাম না। তবে এটি অনেক পুরোনো প্রতিষ্ঠান বলে জানতে পারি।

তিনি বলেন, ৭ আগস্ট মিটিংয়ে পুস্তক প্রকাশক সমিতির নেতা, বিভিন্ন প্রকাশক এবং দু-একটি এনজিও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তবে কে কোন পন্থি, তা আমার জানা নেই। মিটিংয়ে ই-বুক ব্যবসা বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা বলেছি বিবেচনা করে দেখব। পরদিন তারা তাদের মতো করে আরো কিছু প্রকাশকের সঙ্গে বৈঠক করে।

তবে বৈঠকটি নিয়ে নানা শঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ইকবাল হোসেন সানু বলেন, বাংলাবাজারে মূলধারার দুই শতাধিক প্রকাশক আছেন। আমি একটি সমিতির সভাপতি। আমি ও আমাদের সমিতির কাউকে না ডেকে এবং আমাদের অজান্তে শুধু আওয়ামীপন্থি এবং তাদের সঙ্গে থাকা প্রকাশকদের নিয়ে কেন হঠাৎ এই মিটিং! আসলে এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা নিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি।

তিনি বলেন, বৈঠকটির আগে আমরা কেউ এ বিষয়ে জানতাম না। দুদিন পর ফেসবুকে একটি ছবি প্রকাশের পর জানতে পারি। এ নিয়ে বাংলাবাজারে প্রকাশকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া ভারতীয় কোম্পানিটি ই-বুক ব্যবসার নামে বইয়ের হার্ড কপি নিতে চাইছে। এতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। যে ভারতের সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশের দূরত্ব চলছে, সেখানে তারা এখানে এসে কীভাবে মিটিং করল?

বাংলাদেশ সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. গফুর হোসেন বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতীয় কোম্পানির এই মিটিং কি তৎপর্য বহন করে, তা নিয়ে শঙ্কায় আছি। বিশেষ করে গণঅভ্যুত্থানের বছরপূর্তির সময়ে এই বৈঠক কেন? এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাইকে দাওয়াত দিলে সন্দেহের কিছু ছিল না।

তিনি বলেন, ই-বুকের নামে বইয়ের খসড়া পাণ্ডুলিপি দিলে তাদের হাতে সব তথ্য চলে যাবে।

একই ধরনের মন্তব্য করে বৈষম্যবিরোধী সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এর আগে বসুন্ধরা এলাকায় যেভাবে আওয়ামী লীগের গোপন প্রশিক্ষণ হয়েছে, ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশকদের নিয়ে সে ধরনের কোনো বৈঠক কি নাÑতা সন্দেহের বিষয়। তিনি বলেন, বর্তমানে যেখানে বই ছাপা ও বিক্রি তেমন হচ্ছে না, সেখানে দিল্লি থেকে এসে এই বৈঠক করা সন্দেহজনক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকাশক জানান, যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের চিকিৎসাসেবার জন্য ভারত সহসা ভিসা দিচ্ছে না, সেখানে দিল্লির একটি প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তাদের ভিসা দিয়ে গোপনে মিটিং করার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। অনতিবিলম্বে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আসল তথ্য উদঘাটন করা এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই জরুরি। এ নিয়ে আমরা প্রকাশক মহল খুবই উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছি।

তিনি বলেন, আমরা ধারণা করছি, পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসররা দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য প্রকাশকদের ব্যানারে এরকম একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, যাতে সরকারের নজর এড়ানো যায়। তারা যদি কোনো সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এ কাজটি করত, তাহলে তারা অবশ্যই সব প্রকাশককে জানিয়েই কাজটি করত। এসব প্রকাশক ‘শেখ মুজিব’ নামে, ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে ও শেখ পরিবারের সদস্যদের ওপর সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে লেখা ইতিহাসের বই সরবরাহ করে সরকারের কোষাগার থেকে শত শত কোটি টাকা লুট করেছে। এমনও উদাহরণ আছেÑএকই পাণ্ডুলিপি প্রচ্ছদ ও শিরোনাম পরিবর্তন করে তারা বই ছাপিয়ে ‘মুজিব কর্নার’ বা অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করেছে।

মাওলা ব্রাদার্সের ফারুক জানান, এটি কোনো গোপন বৈঠক ছিল না। প্রাথমিক পর্যায়ের একটি বৈঠক। পরবর্তীতে আরো বড় পরিসরে এ নিয়ে বৈঠক হবে বলে শুনেছি। তিনি বলেন, তারা কোনো রাজনৈতিক বই এবং রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করতে পারেÑএমন বই থেকে দূরে থাকার কথা জানিয়েছে।

এএসএপি গ্লোবাল ই-বুকস প্রাইভেট লিমিটেড সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ডিজিটাল উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিক্ষাগত সম্পদের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ উদ্যোগে আপনাকে স্বাগতম। পূর্বে আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স একাডেমিক পাবলিকেশন্স (এএসএপি) নামে পরিচিত একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে আমাদের বিবর্তন বিশ্বব্যাপী জ্ঞান প্রচার ও পরিবেশগত স্থায়িত্বের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।