Image description
অতীতের অনিয়ম দুর্নীতি লুটপাট স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা। ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণের রেকর্ড। বিএফআইইউপ্রধানের অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও অস্থিরতা। সুযোগসুবিধা কমানোয় অর্থ বিভাগের কর্মীদের সচিবের দপ্তরে প্রতিবাদ। অচলাবস্থা ব্যাংক মার্জারেও

অতীতের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা। ব্যাংক খাতে তৈরি হয়েছে প্রভিশন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণের রেকর্ড। আস্থার সংকট কিছুটা কমলেও ইমেজসংকট কাটাতে পারছে না এ খাত। ফলে ব্যাংক খাতে ডিপোজিটের পরিমাণ বাড়লেও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে; যার একটা বড় প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিভাগ বিএফআইইউপ্রধানের অশ্লীল ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যেও চলছে কানাঘুষা। আলোচিত বিএফআইইউপ্রধান শাহীনুল ইসলামকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর কথা বলা হলেও গতকালও তিনি অফিস করেছেন। তাঁর ওপরের আরও তিনজনকে ডিঙিয়ে শাহীনুলকে এ পদে বসানো হয়েছিল। ব্যাংক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে এটা করা হয়েছিল। অথচ দায়িত্ব দেওয়ার পর বছর না ঘুরতেই শাহীনুল নানা রকম অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবারও ইমেজ সংকটে পড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকেরই উচ্চপদস্থরা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে সরকারি কর্মচারীদের কিছু সুযোগসুবিধা কমানোয় সচিবালয়ে কর্মীরা গতকাল অর্থ সচিব ড. খায়েরুজ্জমান মজুমদারের দপ্তরে এসে প্রতিবাদ জানান। এ সময় অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর আগে এনবিআর বিলুপ্ত করে পৃথক দুটি বিভাগ করার প্রতিবাদে শুরু হওয়া আন্দোলন ও অস্থিরতা এখনো কাটেনি। এর জেরে যেসব কর্মকর্তা সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করেছিলেন তাঁদের অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ ছাড়া বহু কর্মীর মধ্যে এখনো চাকরি হারানোর আতঙ্ক কাজ করছে। এতে এনবিআরেও এক ধরনের ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ভিতরেও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর রয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের ভিতরে এ রকম অনেক লোক রয়েছেন যারা এখনো পতিত সরকারের উদ্দেশ্য হাসিল করতে ড. ইউনূস সরকারের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে সংকট তৈরি করছেন। এতে আর্থিক খাতেও ইমেজসংকট তৈরি হচ্ছে বলে জানান অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব। নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘যাঁরা গত ১৬ বছর অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন তাঁদের অনেকেই রং বদলে এখন আবারও সুবিধা নিচ্ছেন।’ এনবিআর, অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো জায়গায়ও এ রকম রং বদলকারী অনেক কর্মী রয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ ধরনের রং বদলকারী মানুষ সব আমলেই কমবেশি থাকে। এবং তা সব সেক্টরেই থাকে। এখনো এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের অংশ হিসেবে অনেক জায়গাতেই পরিবর্তন এনেছে তবু সবাইকে তো আর একসঙ্গে কার্টেল করা যায় না। তাহলে তো সরকারই চলতে পারবে না।’ আর আর্থিক খাতের বড় বড় জায়গায় বসে থাকা রং বদলকারীরা সে সুযোগটাই নিচ্ছেন বলে তিনি মনে করেন। এঁদের কারণে আর্থিক খাতে ইমেজসংকট তৈরি হয়েছে; যার ফলে আর্থিক খাতের সামগ্রিক সংকট কাটানো সহজ হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন। অন্যদিকে চলমান সংকটের কারণে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ব্যাংক মার্জারেও। যেসব ব্যাংক মার্জ করা হবে বলে গভর্নরের তরফে বারবার বলা হচ্ছে অথচ তা কার্যকর করতে অধিক সময় নেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোতে অস্থিরতা আরও বেড়েছে; যা সামগ্রিক ব্যাংক খাতে এক ধরনের ইমেজসংকট তৈরি করছে। এ ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত হয়ে গেছে। আবার দেশের অর্থনীতিতে বর্তমান মন্দাবস্থার কারণেও বহু ব্যবসায়ীর ঋণ খারাপ হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া নতুন নীতিমালার কারণেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ভালো-খারাপ প্রায় সব ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে জুন-২০২৫ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ; যা এযাবৎকালের রেকর্ড পরিমাণ। অথচ ২০২৪ সালের জুনে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের মার্চে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল মাত্র ২৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। এক বছরে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় পৌঁনে ২ লাখ কোটি। ব্যাংক খাতের এ বিশাল পরিমাণ মন্দ ঋণ ও প্রভিশন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের নেতিবাচক সংকেত দিচ্ছে। এতে তাঁরা বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না; যা মূলত দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাতে এক ধরনের ইমেজসংকট তৈরিতে সহায়তা করছে বলেও মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন।

গত বছরের ৮ আগস্ট নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে আর্থিক খাতের সংস্কারসহ নানান উদ্যোগ গ্রহণের পর বছর পেরিয়ে গেলেও এডিপি বাস্তবায়নের হার বাড়ানো যায়নি। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে মাত্র ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করছে; যা মোট এডিপি বরাদ্দের শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যেও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছিল; যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বরাদ্দ থেকে ব্যয় হয়েছিল ২ হাজার ৯২২ কোটি টাকা, যা ছিল ওই অর্থবছরের এডিপি বরাদ্দের ১ দশমিক ০৫ শতাংশ। এ বছর তার চেয়েও কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে।