Image description
ডাকসু নির্বাচন । রেকর্ড গড়ে জয়ের আশা ।

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হয়েছে মোট ছয়বার, যেসব নির্বাচনের পাঁচটিতেই দলীয় প্যানেল দেয় শিবির। তবে এর কোনোটিতেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়নি এই ছাত্রসংগঠনটি। এ সময়ে ডাকসুতে শুধু একটি এবং হল সংসদে কয়েকটি পদ পাওয়ার নজির রয়েছে তাদের। নেতাকর্মীরা বলছেন, শিবির আগে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিলেও এবারের মতো এতটা অবাধে ক্যাম্পাসে কর্মকাণ্ড চালাতে পারেনি। এমন প্রেক্ষাপটে নিজেদের ইতিহাস ছাপিয়ে নতুন করে ইতিহাস লেখার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

এরই মধ্যে ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল ঘোষণা করেছে ছাত্রশিবির। ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ নামে এই প্যানেলে সহসভাপতি (ভিপি) পদে রয়েছেন ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে প্রার্থী ঢাবি শাখার বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদ। আর একই শাখার সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান লড়বেন সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে। এ প্যানেলে ব্যতিক্রম হিসেবে জুলাই আন্দোলনে এক চোখ হারানো খান জসিম ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রাইসুল ইসলামকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। শিবিরের প্যানেলে মনোনয়ন পেয়েছেন একজন চাকমা শিক্ষার্থীও। প্রার্থীর তালিকায় ঠাঁই হয়েছে ৪ নারী শিক্ষার্থীরও।

ডাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হওয়ার বছরগুলোর সংবাদপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, এবারের আগে ডাকসুর অন্তত চারটি নির্বাচনে প্রকাশ্যে প্রার্থী ঘোষণা এবং নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে ছাত্রশিবির, যে নির্বাচনগুলো হয় ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮২ ও ১৯৯০ সালে। এর মধ্যে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে ছাত্রশিবির থেকে সহসভাপতি পদে নির্বাচন করেন আবু তাহের এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচন করেন আব্দুল কাদের বাচ্চু। ওই নির্বাচনে ডাকসুতে সম্পাদকের একটি পদে এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদে শিবিরের প্যানেল থেকে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ওমর ফারুক নির্বাচিত হন বলে জানা যায়। এ ছাড়া ১৯৮০ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ছাত্রশিবিরের তাহের-কাদের পরিষদ, ১৯৮২ সালে ছাত্রশিবির থেকে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচন করেন এনামুল হক মঞ্জু ও আব্দুল কাদের বাচ্চু, ১৯৮৯ সালে আ ন ম শামসুল ইসলাম ভিপি পদে এবং আমিনুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন এবং ১৯৯০ সালে ভিপি পদে মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, জিএস পদে মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান ও এজিএস পদে শফিকুল আলম হেলাল ছাত্রশিবির থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। তবে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে কোনো প্যানেল অংশ নেয়নি।

১৯৯০ সালের নির্বাচনে শিবিরের জিএস প্রার্থী মো. মুজিবুর রহমানের দাবি, ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরুর পর যতগুলো ডাকসু নির্বাচন হয়েছে, তার সবকটিতেই অংশ নিয়েছেন তারা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজিবুর রহমান ১৯৮৮ সালে ছিলেন ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘১৯৮০ সাল থেকেই ছাত্রশিবির ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে শুরু করে। তখন আমাদের জনপ্রিয়তা খুব একটা ছিল না, কর্মীর সংখ্যাও সীমিত ছিল। তাই বড় পদে জয় পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৮২ সালের নির্বাচনে মুহসীন হল ও সলিমুল্লাহ হলে কয়েকটি সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছিলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘১৯৮৯ ও ১৯৯০ পরপর দুবার ডাকসুতে শিবিরের অবস্থান ছিল তৃতীয়। ১৯৯০ সালে ছাত্রদল প্রায় ৩ হাজার, আর ছাত্রলীগ আড়াই হাজারের মতো ভোট পেয়েছিল। ছাত্রশিবিরের ভোট ছিল ১২০০-১৩০০। আমাদের পরে ছিল ছাত্র ইউনিয়নের অবস্থান, যারা ৯০০ থেকে হাজারের মধ্যে ভোট পেয়েছিল।’

ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে এবার ভিপি পদে নির্বাচন করছেন আবু সাদিক কায়েম। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘ছাত্রশিবির যাত্রা শুরুর পর ৫টি নির্বাচনে নিজস্ব প্যানেলে অংশগ্রহণ করে। শুধু ২০১৯ সালে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্যানেল দিতে পারেনি। সে সময় ছাত্রশিবিরের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন হয়েছে, আমাদের নাগরিক মর্যাদা দেওয়া হয়নি এবং আমাদের হত্যাযজ্ঞ করা হয়েছিল। যেটা বাংলাদেশে আর কোনো সংগঠনের ওপর হয়নি। সে কারণে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না।’ এবারের নির্বাচনে ছাত্রশিবির সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করবে বলেও আশাবাদী সংগঠনটির ঢাবি শাখার সাবেক এই সভাপতি।

শিবিরের প্যানেলের বিষয়ে জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ বলেন, ‘কে শিবির করে, কে করেনি—এ চিন্তা মাথায় নিয়ে আমরা প্যানেল গঠন করিনি। বরং শিবিরের সরাসরি সমালোচনা করে এরকম শিক্ষার্থীদেরকেও আমরা অন্তর্ভুক্ত করেছি। কারণ হচ্ছে, এই ক্যাম্পাস সবাইকে নিয়েই গড়তে হবে। ক্যাম্পাসের একমাত্র শিক্ষার্থী যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অঙ্গ হারিয়েছে সেও যেমন এই প্যানেলে আছেন, চাকমা জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করে এরকম একজন প্রতিনিধিও আছেন। শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন একজন শিক্ষার্থীও আছেন। হিজাবধারী ও হিজাব পরে না এরকম শিক্ষার্থীরাও আছেন। সাংস্কৃতিক অনুশীলন পছন্দ করেন, এমন প্রার্থীও আছেন। অর্থাৎ একটি সমাজের সবকিছুর প্রতিফলন এ প্যানেলে রয়েছে। সবার চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই, বাস্তবায়ন করতে চাই। যেহেতু আমাদের প্যানেলে সেটির প্রতিফলন হয়েছে, আমরা আশা করছি শিক্ষার্থীরাও তাদের যোগ্য মতামতের প্রতিফলন ঘটাবেন।’

ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলে আছেন আরও যারা : শিবির নেতৃত্বাধীন এই প্যানেলে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন ইনকিলাব মঞ্চের ফাতিমা তাসনিম জুমা। ২৮ সদস্যের এ প্যানেলে অমুসলিম ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আছেন সর্ব মিত্র চাকমা। এ ছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ইকবাল হায়দার, আন্তর্জাতিক সম্পাদক খান জসিম, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক আসিফ আবদুল্লাহ, সমাজসেবা সম্পাদক শরিফুল ইসলাম মুয়াজ, ক্রীড়া সম্পাদক আরমান হোসাইন, কমন রুম, রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে উম্মে সালমা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে নুরুল ইসলাম সাব্বির, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে এম এম আল মিনহাজ, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে সাখাওয়াত জাকারিয়া, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে সাজ্জাদ হোসাইন খান এবং ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে মাজহারুল ইসলামকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। প্যানেলে আরও ১৩ জন সদস্যপদের প্রার্থী রয়েছেন।

প্যানেল ঘোষণা করে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি সব শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটা সম্মিলিত প্যানেল দেওয়ার জন্য। এ প্যানেল নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে ডাকসুতে যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার এবং ছাত্রদের কল্যাণে যে উদ্যোগ নেওয়া দরকার, ছাত্রশিবির সেটা করবে।’