
একটি জীর্ণ টিনশেড ঘরে ৪০ জন দুস্থ শিশুকে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। বৃষ্টি হলে চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। বারান্দায় হাঁটু সমান পানি জমে যায়। এর মধ্যেই মানবেতর জীবন যাপন করছে শিশুরা।
গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে সমাজসেবার দুস্থ শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রের দুরবস্থা ও অনিয়মের চিত্র এটি। নতুন ডরমিটরি ভবনটি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরের ৯২ কোটি টাকার দুস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের ভয়াবহ অনিয়ম ও অদক্ষতার এই চিত্র পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্মিত ভবনগুলো হস্তান্তর করা হয়নি। এমন অনিয়ম হয়েছে যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠিকাদার কাজ না করেই বিল নিয়ে বসে আছেন। আবার কোনো ক্ষেত্রে ঠিকাদাররা বিল না পাওয়ার কথা বলেছেন।
লিফট ছাড়াই কোটি টাকার বিল : প্রকল্পে সবচেয়ে বড় অনিয়ম ধরা পড়েছে লিফট প্যাকেজে। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী, পাঁচটি লিফট স্থাপনে নির্ধারিত ব্যয় ছিল চার কোটি ৫২ লাখ টাকা। টেন্ডারে সর্বনিম্ন দর ছিল প্রায় তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে কাজ দেওয়া হয় চতুর্থ দরদাতাকে, যার দর সর্বনিম্নের চেয়ে ৭০ লাখ টাকা বেশি। লিফট চালু তো দূরের কথা, এখনো বসানোই হয়নি।
শিশু নয়, অগ্রাধিকার কর্মকর্তাদের : প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল ৪০০ শিশুর নিরাপদ আবাসন। কিন্তু বাস্তবে শিশুদের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে কর্মকর্তাদের আবাসন। প্রকল্পের আওতায় ৪০০ দুস্থ শিশুর জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি ডরমিটরি। অথচ তাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল তিনটি আবাসিক ভবন। এসব ভবনে রয়েছে দুই স্তরের ৬০টি ফ্ল্যাট। অথচ তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ১৯। অর্থাৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর তুলনায় ৪১টি ফ্ল্যাট বেশি নির্মাণ করা হয়েছে।
বাকিগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হবে, এর কোনো যৌক্তিক উত্তর নেই প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে। তাঁরা বলছেন, সেখানে ৩৪ জন জনবল লাগবে, কিন্তু তাঁদের আছে ১৯ জন। আরো ১৫ জন নিয়োগের জন্য চাহিদা দেওয়া হয়েছে। আলোচ্য প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন ২৪ বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা উম্মুল খায়ের সিদ্দিকি, যাঁকে প্রেষণে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হলেও চাকরিজীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই হিসেবে প্রকল্প বাস্তবায়নে তাঁর অভিজ্ঞতা অনেক।
এর পরও প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন বেহাল কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, যেখানে শিশুরা একটা সুন্দর জীবন কাটাতে পারবে।’
লিফটের বিষয়ে তিনি বলেন, লিফট পাওয়ার আগে বিল পরিশোধ করা হয়নি, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিল দেওয়া হয়েছে।
শিশুরা কেন এখনো টিনশেডে থাকছে—এ বিষয়ে তিনি বলেন, শিশুদের জন্য যে ডরমিটরি নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে এখনো কিছু কাজ বাকি রয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের সেখানে তোলা হয়নি।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কেন অতিরিক্ত তিনটি আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে—এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই প্রশ্ন আমারও ছিল। এটার বিষয়ে বলতে পারব না। কারণ আমি তো ডিপিপি তৈরির সময় ছিলাম না। ডিপিপিতে যেভাবে ছিল, সেভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। জনবলসংকট রয়েছে, জনবল নিয়োগের জন্য চাহিদা দেওয়া হয়েছে।’
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পিডি যেন এই প্রকল্পের চিরস্থায়ী পরিচালক। তাঁর ইচ্ছায়ই ঠিকাদারের বিল আটকে আছে, ভবনগুলো হস্তান্তর হচ্ছে না। এর ফলে শিশুরা নতুন ভবনে উঠতে পারছে না, অথচ দৃষ্টিনন্দন ভবনগুলো খালি পড়ে আছে।
ব্যয় বাড়ছে, কাজ থেমে আছে : ২০১৯ সালে ৮১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পেলেও সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ৯২ কোটি টাকায়। কিন্তু কাজ শেষ হয়নি, বরং একের পর এক মেয়াদ বাড়ছে। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্পের জন্য কোনো বরাদ্দই রাখা হয়নি। মার্চ পর্যন্ত এক টাকাও খরচ হয়নি। পরে আরএডিপি বরাদ্দ এলেও জুন ২০২৫-এর মধ্যে কাজ শেষ হয়নি। এখন আবার ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পটি পরিদর্শন করা আইএমইডির কর্মকর্তা মুহাম্মদ কামাল হোসেন তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি গত বছরের জুনেও প্রকল্পটি ভিজিট করেছিলাম। তখন কাজের অবস্থা যেমন দেখেছিলাম, এবারও তা-ই দেখেছি। আমরা দ্রুত দুস্থ শিশুদের জরাজীর্ণ ভবন থেকে নতুন ভবনে শিফট করার জন্য বলেছি।’
ভবনের বিদ্যুতায়নও শুরু হয়নি : আরেকটি বড় অনিয়ম বহির্বিদ্যুতায়ন প্যাকেজে। প্রায় তিন কোটি ৫৩ লাখ টাকার এই কাজের চুক্তি হলেও নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু কাজ শুরুই হয়নি। আইএমইডি পরিদর্শনে দেখতে পায়, ভবনের দরজাগুলো বাঁকা ও ফাটল ধরা, যা নিম্নমানের কাজের প্রমাণ।
শিশুদের প্রতি অবহেলা, প্রকল্পে দুর্নীতি : প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কিন্তু বাস্তবে তারা ভাঙা চালার নিচে দিন কাটাচ্ছে। অন্যদিকে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাব দেখানো হচ্ছে, বিল পরিশোধ করা হচ্ছে, কর্মকর্তাদের জন্য বিলাসী আবাসন বানানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্পের অনিয়মগুলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। আমাদের পর্যবেক্ষণগুলোর ওপর তারা কী ব্যবস্থা নেয়, সেটা আমরা জানাতে বলেছি। তার পরই প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে।’