
ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে ব্যাংক কোম্পানি আইনে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংক খাতের সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ব্যাংক কোম্পানি আইনে বড় ধরনের সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একবার ঋণখেলাপি হলে তারা আর নতুন করে ব্যাংক ঋণ, এলসি বা গ্যারান্টি সুবিধা নিতে পারবেন না। পাশাপাশি সংশোধনীতে ২০২৩ সালে সংযোজিত ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ চিহ্নিত করার ধারা বাদ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের আকার ছোট করা, পারিবারিক প্রভাব কমানো, পরিচালকের মেয়াদ সীমিত করা এবং গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণ সুবিধা সংকোচনের মতো একাধিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সংশোধনীর খসড়া প্রস্তুত করে পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় বর্তমানে খসড়াটি পর্যালোচনা করছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এটি উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই অধ্যাদেশ আকারে জারি করার প্রস্তুতি চলছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অধ্যাদেশ আকারে আইন কার্যকর হলে ব্যাংক পরিচালনায় পরিবারভিত্তিক আধিপত্য কমবে, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে নতুন চাপ তৈরি হবে এবং পেশাদারত্ব বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক বাস্তবায়ন হলে ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে এই সংশোধনী বড় ভূমিকা রাখবে।
ইচ্ছাকৃত খেলাপির ধারা অপসারণ
২০১৩ সালের আগে পর্যন্ত ব্যাংক কোম্পানি আইনে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের সাধারণ তালিকা তৈরি করার নিয়ম ছিল। ২০২৩ সালের সংশোধনীতে যুক্ত হয় “ইচ্ছাকৃত খেলাপি” শ্রেণি, যার আওতায় ব্যাংকগুলোকে আলাদা তালিকা তৈরি করতে হতো। প্রক্রিয়াটি ছিল বহু স্তরবিশিষ্ট— তালিকা প্রণয়ন, ঋণগ্রহীতার ব্যাখ্যা গ্রহণ, আপিলের সুযোগ দেওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদন।
কিন্তু প্রায় দুই বছর পার হলেও এখনও কোনও ঋণগ্রহীতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভাষায়—এটি জটিল ও বাস্তবতা বিবর্জিত হওয়ায় কার্যকর হয়নি। উপরন্তু, কর্মকর্তা পর্যায়ে ব্যাখ্যার সুযোগ থাকায় দুর্নীতির ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।
এ কারণেই নতুন সংশোধনীতে পুরো ধারা বাদ দেওয়া হচ্ছে। তবে খেলাপিদের বিরুদ্ধে প্রচলিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বহাল থাকবে। অর্থাৎ, ঋণখেলাপি হলে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নতুন করে ব্যাংক ঋণ, এলসি বা গ্যারান্টি সুবিধা পাবে না।
পরিচালনা পর্ষদ ছোট করার উদ্যোগ
প্রস্তাবিত খসড়ায় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ জন থেকে কমিয়ে ১৫ জন করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক, অর্থাৎ সাত বা আট জন হবেন স্বতন্ত্র পরিচালক।
বর্তমানে তিন জন পর্যন্ত স্বতন্ত্র পরিচালক রাখা যায়। সংশোধনীর পর স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং সেখান থেকেই ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর ফলে পেশাদার ও নিরপেক্ষ মতামত বেশি গুরুত্ব পাবে এবং শেয়ারহোল্ডারদের অতিরিক্ত প্রভাব কমবে।
পারিবারিক প্রভাব কমানো
ব্যাংক পরিচালনায় দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক প্রভাব একটি বড় সমস্যা। বর্তমানে একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিন জন পরিচালক থাকতে পারেন, পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের মনোনয়নে আরও দুজন থাকার সুযোগ আছে।
নতুন খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে, এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজন পরিচালক থাকতে পারবেন। একইসঙ্গে পরিবারের সংজ্ঞা বিস্তৃত করা হচ্ছে। এখন থেকে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন ছাড়াও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রাও ‘পরিবার’ হিসেবে গণ্য হবেন।
এ উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য হলো শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নিয়োগের প্রচলিত প্রথা বন্ধ করা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে ব্যাংক বোর্ডে পারিবারিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।
পরিচালকের মেয়াদ সীমিতকরণ
বর্তমান আইনে পরিচালক পদে টানা ১২ বছর থাকার সুযোগ আছে। ২০১৮ সালের আগে এটি ছিল ৬ বছর, পরে ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ফের আগের অবস্থায় ফেরা হচ্ছে—একাধিক ক্রমে সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে মোট ৬ বছর পরিচালক থাকা যাবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে একই ব্যক্তি পরিচালক থাকলে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রভাব বাড়ে এবং জবাবদিহি কমে। নতুন বিধানে এই ঝুঁকি কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণনীতি
বর্তমান আইনে কোনও ব্যবসায়িক গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলেও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ সুবিধা পেতে পারে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এই সুযোগ বন্ধ করা হচ্ছে। ফলে গ্রুপভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে ওই গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানও ঋণ সুবিধা হারাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. মো. নজরুল হুদা এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “খেলাপিকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হিসেবে ভাগ করার কোনও বাস্তব মানদণ্ড নেই। বরং এতে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হতো। নতুন সংশোধনী সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।”
তিনি আরও বলেন, ‘‘বোর্ড ছোট করা এবং স্বতন্ত্র পরিচালক বাড়ানো ব্যাংক পরিচালনায় পেশাদারিত্ব আনবে। তবে পরিচালকের সংখ্যা নয়, যোগ্য পেশাদার নিয়োগই মূল বিষয়।’’
আইএমএফের পরামর্শ ও প্রেক্ষাপট
২০২২ সালে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে পারিবারিক প্রভাব কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এরপর ধাপে ধাপে কিছু পরিবর্তন আনা হলেও রাজনৈতিক চাপের কারণে অনেক বিধান শিথিল করা হয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তিন দফা নির্বাচনের আগে পরিচালকের সংখ্যা ও মেয়াদে শিথিলতা দেওয়া হয়েছিল।
তবে চলমান সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে এসব শিথিলতা এখন প্রত্যাহার করা হচ্ছে। নীতিনির্ধারকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ব্যাংক পরিচালনা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বাড়াতে এই সংশোধনীগুলো অপরিহার্য।