Image description

তদারকির অভাবে গ্রাহকের সঙ্গে বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারে জড়িত দেশের বেশ কিছু বীমা কম্পানি। গ্রাহকদের পাওনা বীমা দাবির হাজার হাজার কোটি টাকা শোধ না করে নানা ছুতায় তারা তা আটকে রেখেছে। এ রকম পাঁচ বীমা কম্পানির কাছেই গ্রাহকের পাওনা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বীমা খাতের ৭৮ কম্পানির কাছে সাত হাজার ১৫৮ কোটি টাকা গ্রাহকরা পেলেও মাত্র পাঁচটি কম্পানির কাছেই পাওনা ৭৭ শতাংশ টাকা।

জানা যায়, কম্পানিগুলোর সীমাহীন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে পুরো বীমা খাত এখন ধুঁকছে। সেবার মান তলানিতে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, এই খাতে টাকা জমা দিলেও তা সঠিকভাবে কম্পানিতে জমা হয় না।
তাঁদের টাকা নিয়ে অনেক এজেন্ট পালিয়েছেন। আর যে টাকা কম্পানির কাছে জমা হয়েছে তাও নানা কৌশলে আটকে দিচ্ছে কিছু কম্পানি। তাঁদের দাবির টাকা বছরের পর বছর আটকে রাখছে বেশির ভাগ বীমা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ঘুরেও বীমা দাবির টাকা তুলতে পারছেন না। এমন কর্মকাণ্ডে বর্তমানে তীব্র আস্থা সংকটে পড়েছে খাতটি।

জীবন বীমা খাতে এক কম্পানিই খাতকে টালমাটাল করে রেখেছে। দাবির চার হাজার সাত কোটি টাকার মধ্যে ৭৩ শতাংশ টাকা আটকা আছে ওই কম্পানির কাছে। পুরো খাতকে বেকায়দায় ফেলা এই কম্পানি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স। কম্পানিটির কাছে পাওনা দুই হাজার ৯১৭ কোটি টাকা।

 
জীবন বীমা খাতের বাকি টাকা পাওনা ৩১ কম্পানির কাছে। দেশের ৩৬ জীবন বীমা কম্পানির মধ্যে শতভাগ পাওনা নিষ্পত্তি করেছে চারটি কম্পানি। এমনকি বীমা খাতের মোট পাওনার ৪১ শতাংশ আটকা ফারইস্টের কাছে। আর ৬৭ শতাংশ পাওনা আছে দুটি কম্পানির কাছে।

জীবন বীমার বাইরে সাধারণ বীমায় সর্বোচ্চ পাওনা বাংলাদেশ সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছে। এই প্রতিষ্ঠানটির কাছে সার্বিক খাতের মধ্যে বীমা দাবি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রতিষ্ঠানটির কাছে এক হাজার ৮৯০ কোটি টাকা পাওনা আছেন গ্রাহকরা। তৃতীয় অবস্থানে আছে গ্রীন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে বীমা দাবির টাকা আটকা আছে ২৭০ কোটি ২১ লাখ। ২৪০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা বীমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে চতুর্থ স্থানে আছে এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি। ১৭৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা পাওনার মধ্যে মাত্র এক কোটি ২৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি। বীমা দাবির মধ্যে ৯৯.২৮ শতাংশই পরিশোধ করেনি। ১৭৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা বীমা দাবি পরিশোধ না করে পিছিয়ে থাকায় পঞ্চম অবস্থানে এই কম্পানি। এ ছাড়া কোটি কোটি টাকা গ্রাহকের বীমা দাবি আটকা আছে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্স, ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স, ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স, বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্স, রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স ও পিপলস ইনস্যুরেন্সসহ বেশ কয়েকটি কম্পানির কাছে।

আইডিআরএর সর্বশেষ তথ্য বলছে, ৩৬ জীবন বীমা কম্পানির ২৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬০৩টি দাবি উত্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে ১৫ লাখ ৮২ হাজার ১৫২টি। অর্থাৎ এখনো ১৩ লাখ পাঁচ হাজার ৪৫১টি বীমা দাবি অপরিশোধিত রয়েছে। এই অবস্থায় ১৫টি বীমা কম্পানি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্য মতে, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৩৬টি জীবন বীমা কম্পানির মোট বীমা দাবির পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৩৭৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো দাবি নিষ্পত্তি বা পরিশোধ করেছে দুই হাজার ৩৬৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এ সময় চার হাজার ছয় কোটি ৯৪ টাকার বেশি বীমা দাবি অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ পরিশোধ করা হয়নি। যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ফলে মেয়াদপূর্তির পরও ১৩ লাখ পাঁচ হাজার ৪৫১ গ্রাহক তাঁদের টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।

দেশের বীমা খাত নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিনের সুশাসনের অভাবে গ্রাহকদের বীমা দাবির অর্থ ঠিকমতো পরিশোধ হয়নি। এ কারণে বীমা খাতে চরম আস্থার সংকট চলছে। এই প্রধান সমস্যা থেকে খুব দ্রুত উত্তরণ সম্ভব নয়। এর জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিদ্যমান আইনে এত দিন আইডিআরএ যথাযথভাবে বীমা কম্পানিগুলোকে তদারকি বা সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আইনে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এতে দুর্নীতি, অনিয়মসহ বহু কিছু হচ্ছে, কিন্তু আইডিআরএ কিছু করতে পারেনি। ফলে বীমা খাতের এই অবস্থার তৈরি হয়েছে। এমনকি আইডিআরএকে শুধু আইনগতভাবে পঙ্গু করা হয়নি, আর্থিকভাবেও পঙ্গু করা হয়েছে।

 

তিনি আরো বলেন, এখন এই খাতের ঝুঁকি নিরসণের দিকে যাচ্ছি। ঝুঁকির ক্ষেত্রে আমরা সাতটি মানদণ্ড চিহ্নিত করেছি, যার ভিত্তিতে কম্পানিগুলোকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে প্রিমিয়ামের প্রবৃদ্ধির হার কেমন, লাইফের ক্ষেত্রে পলিসি নবায়নের অনুপাত ও নন-লাইফের ক্ষেত্রে দাবির অনুপাত, মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা, ব্যবস্থাপনা ব্যয়, শীর্ষ কর্মকর্তাদের পেশাগত যোগ্যতা এবং আইন ও বিধিবিধান পরিপালন। এই মানদণ্ডগুলোর ওপর ভিত্তি করে আমরা মূল্যায়ন করছি, একটি প্রতিষ্ঠান কতটুকু ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেসব বীমাকারী প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিতে রয়েছে বলে আমরা মনে করছি, এরই মধ্যে সেগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিতে পড়ার জন্য কারা দায়ী, সেগুলো নিরীক্ষায় চিহ্নিত করা হবে। চিহ্নিত করার পর তাদের বিষয়ে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে এবং অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, নিরীক্ষায় উঠে আসার বিষয়ে বীমাকারীর রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা আশাবাদী, যারা লাইন চ্যুত হয়েছে, তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারব।

দীর্ঘদিনে বীমা দাবি না পাওয়া এক ভুক্তভোগী গ্রাহক পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার শৌলা গ্রামের বাসিন্দা শাহিনুর বেগম। তিনি ২০১০ সালে সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি থেকে ১০ বছরের মেয়াদি পলিসি নেন। এরপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বীমার মেয়াদ পূর্ণ হয়। তিনি ৬০ হাজার টাকার পলিসি নিয়ে সম্পূর্ণ টাকা জমা দিয়েছেন। মেয়াদ শেষে শাহিনুর বেগমের পাওনা কোনো টাকাই পরিশোধ করছে না প্রতিষ্ঠানটি। এই টাকা পাওয়ার আশায় অনেক দিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে শুধু আশ্বাস দিচ্ছেন, অর্থ পাচ্ছেন না।

বীমা আইন অনুসারে, পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের কাছে সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বীমা দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। অর্থাৎ গ্রাহককে তাঁর টাকা পরিশোধ করতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব ধরনের বীমা দাবি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয় আইডিআরএ। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশও আমলে নিচ্ছে না বীমা কম্পানিগুলো।

বীমা দাবি পরিশোধ না করায় গ্রাহকের টাকা আটকে রাখার ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে আছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ। এই প্রতিষ্ঠানে এস আলমের পাশাপাশি ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সালমান এফ রহমানের। এ বিষয়টি নিয়ে জানতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের ভারপ্রাপ্ত সিইও শহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি জবাব দেননি।

আইডিআরএর সর্বশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জীবন বীমা খাতে গ্রাহকের অপরিশোধিত অর্থের ৮০ ভাগই আটকে রেখেছে পাঁচটি বীমা কম্পানি। বীমা দাবি পরিশোধে পিছিয়ে থাকা এই পাঁচ কম্পানির একটি সানফ্লাওয়ার লাইফ ইনস্যুরেন্স। বিকল্প ধারার সাবেক মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নানের এই প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের বড় অঙ্কের পাওনা যা ১৭৫ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করেনি। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একই অবস্থা গ্রীণ ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কম্পানির। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারজানা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি জবাব দেননি।

এ বিষয়ে আইডিআরএর পরামর্শক সাইফুন্নাহার সুমি কালের কণ্ঠকে বলেন, বীমা খাতের দীর্ঘদিনের বিশৃঙ্খলা এখন আস্থার সংকট তৈরি করেছে। বিশেষ করে গ্রাহকদের বীমা দামি যথাসময়ে পরিশোধ হয়নি। এ কারণে বীমা দাবি নিষ্পত্তি না হওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। এই বীমা দাবি পরিশোধের বিষয়ে আইডিআরএ তগিদ দিয়ে আসছে। কম্পানিগুলোকে বারবার চিঠি দিয়ে বলা ছাড়া কিছুই করার নেই নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের। আইনে তাদের বাধা রয়েছে। এ কারণে কর্তৃপক্ষ বেশি কিছু বলতে গেলে উল্টো মামলা দিচ্ছে কম্পানি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের স্থগিত আদেশ নিয়ে এসে ইচ্ছামতো কার্যক্রম চালিয়ে এসেছে এসব কম্পানি। তাই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন আইন বাস্তবায়ন হলে এই সমস্যা সমাধান করে খাতের পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।

একসময় জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান ছিল প্রায় ১ শতাংশ। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ০.৪৫ শতাংশে। তবে সব কম্পানির চিত্র এমন নয়। আলফা ইসলামী, এলআইসি, মার্কেন্টাইল ও সান্তা লাইফ ইনস্যুরেন্স শতভাগ দাবি পরিশোধ করেছে। রূপালী, ট্রাস্ট ও সোনালী লাইফ দাবি পরিশোধ করেছে ৯৯ শতাংশ। গার্ডিয়ান, মেটলাইফ, স্বদেশ, মেঘনা, প্রগতি, সন্ধানী, বেস্ট লাইফসহ আরো ১২টি কম্পানি ৮০ থেকে ৯৮ শতাংশ দাবি পূরণ করেছে। তবে এখন বেশির ভাগ কম্পানির দাবি পূরণের অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। আর পিছিয়ে থাকা কম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে ঠিকমতো দাবি পরিশোধ করছে না। এ কারণে দিনে দিনে আর্থিক সংকট বাড়িয়ে ঝুঁকিতে ফেলছে।

 পরিস্থিতি এমন, দেশে বীমা পলিসি নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মানুষের আস্থাহীনতা। এর বাইরে দাবি নিষ্পত্তিতে কম্পানিগুলোর প্রক্রিয়াগত জটিলতা, গ্রাহকদের দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে অনীহা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব এবং বীমা কম্পানির এজেন্ট বা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সন্তোষজনক সেবা না পাওয়াও বীমা খাতের বিকাশে বাধা হয়ে আছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টব্যক্তিরা। তাঁরা বলেছেন, কম্পানিগুলোর একাংশ দাবি পরিশোধ না করতে পারাই বীমার প্রতি গ্রাহকদের আস্থাহীনতার বড় কারণ। এ কারণে দেশের মানুষের মধ্যে বীমা গ্রহণের হার বাড়ছে না। মানুষ মনে করেন, ঝুঁকি দূর করতে গিয়ে আবার ঝুঁকি নেব নাকি। যদিও বীমা খাতের জন্য বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময়।