Image description

দেরিতে হলেও সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পটির দরপত্রের মূল্যায়নের কাজ জোরেশোরে চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর অনিয়মের অভিযোগে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে নেয়া ৩৭টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প স্থগিত করা হয়। এরপর সরকার নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে। স্থানীয় বিনিয়োগকারী এবং যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে আনুমানিক সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সরকারের নবায়নযোগ্য শক্তি সমপ্রসারণের প্রধান পরিকল্পনাটি বাধার মুখে পড়তে পারে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বল পর্যবেক্ষণ, ভূমি সংক্রান্ত ছাড়পত্রতে জালিয়াতি এবং অংশগ্রহণকারীদের সঠিক আর্থিক সক্ষমতা যাচাইকরণের অবর্তমানে এই উদ্যোগগুলো বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিদেশি বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর বিনিয়োগ থাকা সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থগিত করা হয়। ফলে সৌর বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি এবারের দরপত্রে জমি সংক্রান্ত শর্তে বলা হয়, জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিষয়ে স্থানীয় এসিল্যান্ডের সনদ জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুদ্রার ঝুঁকি। দরপত্রে বলা হয়েছে, ৭০ শতাংশ অর্থ ডলারে এবং ৩০ শতাংশ বাংলাদেশি টাকায় পরিশোধ করা হবে, কিন্তু স্থানীয় অংশের জন্য কোনো মুদ্রাস্ফীতি অ্যাডজাস্টমেন্ট নেই। এসমস্ত বিবেচনায় যে সমস্ত উদ্যোক্তারা দরপত্রে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের প্রস্তাবনাগুলো সঠিকভাবে যাচাই না হলে এই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)-এর প্রধান জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম মানবজমিনকে বলেন, দরপত্রে অংশগ্রহণকারীরা তো তাদের তথ্য দিবেই। তবে দেখতে  হবে অভিজ্ঞতা কতোটুকু। ইতিপূর্বে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে কিনা। আর্থিক সক্ষমতাও দেখতে হবে। আর্থিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে বিদেশি কোনো বিনিয়োগকারী আছে কিনা।  সতর্কতার সঙ্গে কাগজপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করতে হবে। এমনিতেই ৮ মাস চলে গেছে। কাজের জন্য যে প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে বাছাই করা হলো সেটি উপযুক্ত কিনা তা ভালোভাবে মূল্যায়ন করার পরামর্শ দেন তিনি। 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌর বিদ্যুতের জন্য কোম্পানি বার্ষিক টার্নওভার চাওয়া হয়েছে ৮ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলার। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল চাওয়া হয়েছে ৫৭ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রতি মেগাওয়াটের জন্য ৫,০০০ ডলার টেন্ডার সিকিউরিটি চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভূমির জন্য স্থানীয় এসি ল্যান্ড এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার ছাড়পত্র চাওয়া হয়েছে। এই কারণে  সরকারের উচিত প্রতিটি প্রকল্পের জন্য আগ্রহী উদ্যোক্তার আর্থিক সক্ষমতা এবং প্রযোজ্য ছাড়পত্রগুলো আলাদাভাবে যাচাই করা। যোগ্যতা অনুযায়ী, প্রতিটি টেন্ডারে অংশগ্রহণের জন্য অংশগ্রহণকারীর প্রতি মেগাওয়াট অনুযায়ী অর্থায়নের বিষয়টি নিবিড় তদারকি করতে হবে। 

সূত্র মতে, এর আগে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর অনিয়মের অভিযোগে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে নেয়া ৩৭টি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প স্থগিত করেছে। এসব প্রকল্পের অনেকগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল। একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অনুমোদন পাওয়ার পর যাতে সক্ষমতার অভাব দেখা না দেয় এজন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা তদারক দরকার এবং নতুন দরপত্রে তাই উল্লিখিত আছে। 
সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের জমা পড়া দরপত্রগুলোর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম মানবজমিনকে বলেন, এবার উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এখানে গোপন কিছুই নেই। অনেকগুলো কোম্পানি দরপত্রে অংশ নিয়েছে। আমরা ইভ্যুলেশনের কাজ শুরু করেছি। টেকনিক্যাল মূল্যায়ন করা হচ্ছে। সেসব কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে, অংশগ্রহণকারীরা তা সঠিকভাবে দিয়েছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। 

জানা গেছে, ৫,২৩৮ মেগাওয়াটের ৫৫টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে চারটি টেন্ডার প্যাকেজ  আহ্বান করা হয়। প্রথম ধাপের টেন্ডার দুর্বল সাড়া পেয়েছিল, দ্বিতীয় ধাপেও ১০টি প্লান্টের জন্য মাত্র ২১টি দরপত্র পাওয়া গেছে। অপেক্ষাকৃত কম সাড়ার কারণে টেন্ডার জমা দেয়ার সময়সীমা পাঁচবার বাড়ানো হয়েছে। 

দ্বিতীয় টেন্ডারটি প্রাথমিকভাবে ৮ই জানুয়ারি প্রকাশ করা হয়েছিল, যার নথি জমা এবং দরপত্র খোলার সময়সীমা ছিল ১০ই মার্চ, কিন্তু দুর্বল সাড়ার কারণে প্রক্রিয়াটি স্থগিত হয়ে যায়। এরপর পিডিবি সময়সীমা দু’বার বাড়িয়ে ১৫ই মে জমা এবং দরপত্র খোলার তারিখ নির্ধারণ করে, তারপর আরও তিনবার পিছিয়ে চূড়ান্তভাবে ১৮ই জুন দরপত্র খোলার সময়সূচি নির্ধারণ করে। দরপত্রের নথি থেকে জানা যায়, এককভাবে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড বিভিন্ন ক্ষমতার ২৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দরপত্র জমা দেয়। এককভাবে এটিই সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া দেশ এনার্জি ৯টি, কনফিডেন্স ৭টি, বারাকা ৬টি এবং মীর ৫টি।  দরপত্রের নথি থেকে দেখা যায় যে, কক্সবাজার (উত্তর) ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাবস্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত ৫০ মেগাওয়াট প্রস্তাবিত সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, কর্ণফুলী-বারাকা শিকলবাহা কনসোর্টিয়াম, এবং কনফিডেন্স পাওয়ার বগুড়া ইউনিট-২ লিমিটেড থেকে তিনটি  দরপত্র পাওয়া গেছে। কক্সবাজার ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাব- স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত আরেকটি প্লান্টও একই তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে দরপত্র পেয়েছে। গোপালগঞ্জ প্লান্টের জন্য, যা একটি ১৩২/৩৩ কেভি সাব- স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, দেশ এনার্জি চাঁদপুর পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, এবং বিজনেস রিসার্চ ইন্ট করপোরেশন ইনক ও চাংঝু ট্রিনা ইন্টেলিজেন্স এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের একটি যৌথ উদ্যোগ থেকে তিনটি দরপত্র জমা পড়েছে।

চুয়াডাঙ্গার প্লান্টের জন্য, যা একটি ১৩২/৩৩ কেভি সাব-স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ছিল একমাত্র দরদাতা। জলঢাকা প্লান্টটি ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, কনকর্ড প্রগতি কনসোর্টিয়াম লিমিটেড এবং পিনাকেল ঝংবিংতাই ইন্টারন্যাশনাল বিডি লিমিটেড থেকে তিনটি দরপত্র পেয়েছে।
পঞ্চগড়ে, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড এবং কনফিডেন্স পাওয়ার বগুড়া ইউনিট-২ লিমিটেড স্থানীয় গ্রিড সাব-স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত ৫০ মেগাওয়াট প্লান্টের জন্য দরপত্র জমা দিয়েছে। ফরিদপুর প্লান্টের জন্য ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড আবারো একমাত্র দরদাতা ছিল।

বিবিয়ানা ২৩০/১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাব-স্টেশনের  সঙ্গে সংযুক্ত প্লান্টটি পিএইচএল-পিটিএল জেভি (প্যারামাউন্ট), দেশ এনার্জি চাঁদপুর পাওয়ার কো লিমিটেড এবং এমটিএল-সিএইচআই-পিসিএল-এমএসএল জেভি থেকে দরপত্র পেয়েছে। মুক্তাগাছা ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাব-স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত প্লান্টের জন্য ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ছিল একমাত্র দরদাতা, আর শাহজীবাজারের সঙ্গে সংযুক্ত প্লান্টের জন্য এমটিএল-সিএইচআই-পিসিএল-এমএসএল জেভি ছিল একমাত্র দরদাতা।