
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ দিন দিন বাড়ছে। রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনগুলোকে নিয়ে গঠিত এই কমিশন ইতিমধ্যে দুই দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষ করেছে। উদ্দেশ্য রাজনীতি
ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের পথ খুঁজে বের করা। কমিশন বলছে, সকলের সঙ্গে বসে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির পথ বের হবে। সনদ স্বাক্ষরিত হবে এবং স্বৈরাচার ফিরে আসার পথ রুদ্ধ হবে। দলগুলোকে জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া পাঠিয়ে মতামত জানাতে তাগিদ দিচ্ছে কমিশন। মতামত জমা দেয়ার সময় আজ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যদিও বিএনপিসহ অনেক দল ইতোমধ্যে মতামত জমা দিয়েছে।
বর্তমান সরকারের সময়েই কয়েকটি দল সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন কাঠামো চূড়ান্ত করার ওপর জোর দিচ্ছে। চূড়ান্ত খসড়ায় দলগুলো বিভিন্ন সংশোধনী, নতুন প্রস্তাব ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মত দিয়েছে। এ অবস্থায় কমিশন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করছে। আলোচ্য বিষয়- সনদের আইনি ভিত্তি কী হবে এবং কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব এসব বিষয়ে করণীয় নিয়ে ভাবা হচ্ছে। সবমিলিয়ে জুলাই সনদকে ঘিরে রাজনৈতিক মেরূকরণ দিন দিন বাড়ছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দলের মতবিরোধ ও প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। তৃতীয় দফার বৈঠকে কমিশন কীভাবে এই সংকটের ইতি টানবে তা নিয়ে দলগুলো আগ্রহী।
কমিশন সূত্র জানায়, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চূড়ান্ত করতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হচ্ছে। দলগুলোর চূড়ান্ত মতামত পাঠানোর পর তৃতীয় দফায় তাদের সঙ্গে বসে আইনি ভিত্তি ঠিক করা হবে। এখন পর্যন্ত সবগুলো দলের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সকলের মতামতের ভিত্তিতে একটি পথ ও পদ্ধতি খুঁজে পাওয়া যাবে। এতদিনের আলোচনার ও ঐকমত্যের বিষয়টির সুরক্ষা প্রয়োজন বলেও মনে করে কমিশন। কমিশন এখনো আশাবাদী এই সনদে সবাই স্বাক্ষর করবে। মতবিরোধগুলো দূর হবে এবং সনদ স্বাক্ষরিত হবে।
নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর কমিশনের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। খসড়ার অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, এই সনদের কোনো বিধান বা প্রস্তাব ব্যাখ্যা সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে। এ ছাড়াও, এই সনদের বৈধতা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। যেসব প্রস্তাব, সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার বাস্তবায়ন করবে।
এরইমধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি মাঠে নেমেছে। তাদের দাবি- জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি স্পষ্ট করতে হবে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সময় থেকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এমনকি জামায়াতে ইসলামী হুঁশিয়ারি দিয়েছে- আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন কাঠামো নির্ধারণ না হলে কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা করবে তারা। বিএনপি বলছে, কোনো ডকুমেন্টই সংবিধানের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে নয় দলটি। সাংবিধানিক প্রাধান্য, আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে কিনা- এসব বিষয়ে বিএনপি দ্বিমত পোষণ করেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ মানবজমিনকে বলেন, আইনি ভিত্তির বিষয় নিয়ে এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলছি। এ আলোচনা অব্যাহত আছে। রাজনৈতিক দলগুলো বাইরে তাদের মতামত দিচ্ছে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে মতামত দেয়া হয়েছে। আমরা সেটা পর্যালোচনা করছি। অন্যান্য দলগুলো আজ মতামত দেবেন বলে আশা করছি। মতামত পাওয়ার পর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবো।
তিনি আরও বলেন, আমরা এখনো পর্যন্ত প্রত্যেকের বক্তব্য পাইনি। সেহেতু এ বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করবো না। আমরা আশাবাদী সকলের সঙ্গে আলোচনায় একটি পথ ও পদ্ধতি খুঁজে পাওয়া যাবে। এতদিনের আলাপ-আলোচনার মধ্যদিয়ে যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, এটার সুরক্ষা প্রয়োজন। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়নের পথ এবং আইনি ভিত্তির বিষয়টি নিষ্পত্তি করা যাবে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না- এই এখতিয়ার কি আমাদের সংবিধান কাউকে দিয়েছে? আমার মনে হয় এটা সঠিকভাবে উচ্চারিত হয়নি। এটা অন্য কোনোভাবে হয়তো লেখা যেতো। আদালতে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে। জাতীয় জুলাই সনদ সংবিধানের উপরে প্রাধান্য পেলে একটি খারাপ নজির স্থাপন হবে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান মানবজমিনকে বলেন, প্রায় দুই হাজার মানুষ জীবন দিয়েছেন। ৩০/৩৫ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। লাখ লাখ মানুষ আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। ফ্যাসিবাদ বিদায় করে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি মৌলিক সংস্কার করতে হবে। হত্যার বিচার করতে হবে।
তিনি বলেন, প্রায় দুই দশক মানুষ ভোট দিতে পারে নাই। অন্তর্বর্তী সরকার একটি লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবেন। জুলাই সনদের জন্য দীর্ঘ দুই মাস ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা করে ঐকমত্য হয়েছি। এসব বিষয়কে আইনি ভিত্তি দিতে হবে এবং সংবিধানে সংযুক্ত করতে হবে। পরবর্তী সংসদে বাস্তবায়নের পক্ষে নই আমরা। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান দৃঢ়। জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামীর নির্বাচনের দাবিতে আমরা অনেক কর্মসূচি ইতিমধ্যে করেছি। প্রয়োজনে আমরা আরও কর্মসূচি পালন করবো। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দিয়ে সরকার এগোতে থাকলে, তখন আমরা চিন্তা করবো কী করা যায়। তবে, নির্বাচনের বিরোধিতা করছি না আমরা। নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছি। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় থেকেই। এর সঙ্গে সংস্কার ও বিচারকে দৃশ্যমান করতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও দপ্তর সম্পাদক শাকিল উজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে এই সনদে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই এই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে।