
বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আইয়ুব আলী। তিনি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে হওয়া প্রকল্প বিআইডব্লিউটিপি-১ এর প্রকল্প পরিচালকও। অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি করে তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। আছে একাধিক বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, মুরগির খামার, গরুর খামার, বায়োগ্যাস প্লান্ট, মাছের ঘের ও ধানি জমি। ২০১২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই সম্পদ গড়েছেন। শুধু দেশে নয়, সম্পদ কিনেছেন বিদেশেও। গত কয়েকদিন অনুসন্ধান চালিয়ে আইয়ুব আলীর জ্ঞাত-আয় বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য পেয়েছে মানবজমিন। অনুসন্ধানে ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন উপজেলায় আইয়ুব আলী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে এসব সম্পদের তথ্য মিলে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইয়ুব আলীর ঢাকা, ফতুল্লা, কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, পূর্বাচল, কালীগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, শালিখা, ভৈরব, বাঘারপাড়ায়ও জমি কিনেছেন। এসব জমি তিনি ছেলে নাভিদ ফারহান ঐশিক, স্ত্রী ফারজানা নাহিদ লিজা, মেয়ে পূর্ণতা ফারজানা, ভাই ওলিয়ার রহমান মোল্লা, মোশারফ হোসেন মোল্লা, ইউনুস মোল্লা ও একমাত্র বোন হালিমা বেগমের নামে কিনেছেন।
নামে-বেনামে যত সম্পদ: আইয়ুব আলীর স্ত্রী ফারজানা নাহিদের নামে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ১৩ নম্বর রোডে একটি ৩ কাঠার প্লট রয়েছে। এম- ব্লকের প্লট নং-৩৪০৮। প্লটটিতে ৭ তলা ভবন নির্মাণকাজ চলছে। এছাড়া বারিধারা ডিওএইচএস ২-নম্বর লেনে ২২০০ স্কয়ার ফিটের দু’টি ফ্ল্যাট রয়েছে। সাভার আশুলিয়ার আকরানে বাইতুন নূর জামে মসজিদের পাশে ১১ শতাংশ জমিতে গরুর খামার করেছেন তিনি। এছাড়া ঢাকার পশ্চিম ধানমণ্ডির টালি অফিস মনোয়ারা সিকদার এপার্টমেন্ট ২৯৫/এ/১ নং বিল্ডিংয়ে দু’টি ফ্ল্যাট আছে তার। একই এলাকায় ধানমণ্ডির জিগাতলা নিঝুম আবাসিক এলাকায় ২০০০ স্কয়ার ফিটের আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। ৭০/৭ এই ঠিকানায় ফ্ল্যাট নম্বর- ৩/এ। এছাড়া ধানমণ্ডি ৫ নম্বর রোডের শেষ মাথার বাড়িতে তার একটি ৩২০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট রয়েছে। সেখানে তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। এছাড়া আইয়ুব আলী ও তার স্ত্রীর নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি জমি রয়েছে চরচারতলা ইউনিয়নের চরচারতলা মৌজায়। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অল্প সামনে এগিয়ে হাতের ডানপাশে ৫০ শতাংশ জমিতে একটি বড় মুরগির খামার নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে দু’টি ৫ তলা ভবন নির্মাণ করে মুরগি পালন ও বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। অন্তত ১০০০ হাজার পরিবারকে গ্যাস সাপ্লাই দেয়ার টার্গেট নিয়ে প্রকল্পটি করা হচ্ছে। এটি প্রায় ১০ কোটি টাকার প্রকল্প। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফাইজুর রহমান এই প্রকল্পের দেখভাল করছেন। এর পাশেই বিশাল মাছের ঘের রয়েছে। আশুগঞ্জে নদীবন্দরে ২১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন একটি আধুনিক কার্গো টার্মিনাল নির্মাণ করছে বিআইডব্লিউটিএ। এই প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক আইয়ুব আলী। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান ফাইজুর রহমান। আইয়ুব আলী তাকে এই কাজ দিয়েছেন বলে আলোচনা আছে। এই কাজ দেয়ার বিনিময়েই মুরগির খামার করে দিচ্ছেন এমন আলোচনাও আছে।
চরচারতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফাইজুর রহমান এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, আমি কার্গো টার্মিনাল নির্মাণে মূল প্রকল্পের ঠিকাদার নই। তবে আমি ওই প্রজেক্টে ইট, বালু, খোয়া, রড, সিমেন্ট সাপ্লাই দিয়েছি। ওখান থেকেই আইয়ুব আলীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু মুরগির খামার আমার ব্যক্তিগত টাকায় হচ্ছে। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, আপনার এমন প্রকল্প করার মতো অর্থ নেই, কীভাবে করছেন এ প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি সত্য, আমি জমি বিক্রি করে এই প্রজেক্ট করছি।
ওদিকে ঢাকার হাজারিবাগ এলাকায় স্ত্রীর নামে ২৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন আইয়ুব আলী। এছাড়াও হাজারীবাগ এলাকায় আরও তিনটি ১৭০০, ১৯০০ ও ২২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট থাকার তথ্য মিলেছে। শ্যালকের নামে মোহাম্মাদপুর হাউজিং এস্টেটের সি-ব্লকে ৫০৩/এ ২২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন আইয়ুব আলী। ঢাকার আশুলিয়ায় ২০ কাঠা করে ৩টি প্লট আছে তার। ঢাকার পূর্বাচলে আছে ৫ কাঠার ২টি প্লট। আফতাবনগরে ৪.৫ কাঠার ৩টি প্লট তার নিজের নামে রয়েছে।
স্ত্রীর নামে যতো জমি: ঢাকা জেলা শুলশান উপজেলা বড় কাঁঠালদিয়া মৌজায় ১২৫৩৪ নম্বর খতিয়ানে আইয়ুব আলীর স্ত্রীর নামে ৪.৯৫ শতাংশ জমি রয়েছে। এটা মূলত বাড্ডা সাঁতারকুল এলাকায়। এই জমিতে একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া মাগুরা শালিখা উপজেলা পুকুরিয়া মৌজায় ৫৬৯ নং- খতিয়ানে ৮.৮ শতাংশ জমি আছে। পাশের কুমারকোটা মৌজার ৩৬৭ নং খতিয়ানে ৬৫.৫ শতাংশ জমি রয়েছে। একই মৌজায় ৩৬৫ নং খতিয়ানে ৩ শতাংশ ও ৩৬৬ নং খতিয়ানে ১১৬.৬ শতাংশ জমি রয়েছে। এছাড়া আড়পাড়া মৌজায় ২৭১৪ নং খাতিয়ানে ২৪ শতাংশ জমি আছে তার। কয়েকটি ভূমিতে গরু ও মাছের খামার রয়েছে।
আইয়ুব আলীর নামে যত জমি: ঢাকা কেরানীগঞ্জ ঘাটারচর মৌজায় ১৭৭ নং খতিয়ানে ৬.৫ শতাংশ জমি আছে আইয়ুব আলীর নামে। জমিটি তিনি সম্প্রতি বিক্রি করেছেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জ হিরনাল মৌজায় ৪৯২ নং খতিয়ানে ৪.৯৫ শতাংশ, ঢাকা মিরপুর-১২ মৌজায় ২৫-৩৮৩৭ নং খতিয়ানে ৫ শতাংশ, যশোর বাঘারপাড়া নারিকেল বাড়িয়া পাঁচবাড়িয়া মৌজায় ৮৮৩ নং খতিয়ানে ২৭৬ শতাংশ জমি রয়েছে। যশোরের এই জমিতে গরুর খামার রয়েছে।
ছেলে নাভিদ ঐশিকের নামে যত সম্পদ: ইব্রাহিমপুর মৌজায় ৬৬০২ নং খতিয়ানে .৩৫২৯ শতাংশ জমি রয়েছে। এটি মূলত ছেলের নামে একটি ফ্ল্যাট। এটা মিরপুরে দুই নম্বরে অবস্থিত। এছাড়া মিরপুর ডিওএইচএস ও পূর্বাচল জলসিঁড়ি প্রকল্পের ছেলের নামে ফ্ল্যাট ও বাড়ি করেছে আইয়ুব আলীর।
আইয়ুব আলী ২০২১ সালে লন্ডনে এবং ২০২৩ সালে নিউ ইয়র্কে বাড়ি ক্রয় করেছেন বলে জানা গেছে। সেখানে ছেলেদের একাউন্টে টাকা জমা করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ছেলেদের নামে অস্ট্রেলিয়ায়ও বিপুল পরিমাণ সম্পদ কিনেছেন আইয়ুব আলী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ’তে চলমান সব ড্রেজিং প্রকল্পে প্রতি ঘনমিটারে যে ব্যয় হয় ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রতি ঘনমিটার ড্রেজিং খরচ বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি দেয়া হয়। এই কাজে আইয়ুব আলী সহায়তা করেন। দু’টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১৪০ লাখ ঘনমিটার মাটি অপসারণের বিল বাবদ ৭০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এই বিলের একটি বড় অংশ লোপাট হয়েছে। যা ভাগ-বাটোয়ারা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বঙ্গ ড্রেজার্স লিমিটেড, কর্ণফুলী ড্রেজিং লিমিটেড ও আইয়ুব আলীর মধ্যে। গত ১৫ বছরে আইয়ুব আলী ড্রেজিং বিভাগের আওতাধীন ড্রেজার সহায়ক জলযান মেরামতের কাজ তার সিন্ডিকেট ঠিকাদারদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতেন। তিনি বিআইডব্লিউটিএ’র সমাপ্ত প্রকল্পের ড্রেজার ও আনুষঙ্গিক জলযান ক্রয় সংগ্রহ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক ও পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে আইয়ুব আলী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক। প্রকল্পটিতে ড্রেজিংয়ের নামে কোটি কোটি টাকা অপচয় করার অভিযোগ রয়েছে।
ড্রেজিং সাম্রাজ্যের রাজা: গত বছরের ৫ই আগস্ট বুড়িগঙ্গা তীর রক্ষা ৩০০ কোটি টাকার একটি নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেন আইয়ুব আলী। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ওই প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দিতে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে আইয়ুব এখনো টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন। আইয়ুব আলী সাইফুজ্জামান শেখরের খালাতো ভাই পরিচয় দিয়ে একচ্ছত্র দাপট দেখাতেন। একাধিবার ড্রেজারের তেল চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত প্রকৌশলী আইয়ুব আলী বিরুদ্ধে মামলাও হয়। সম্প্রতি কেনা ১১টি নিম্নমানের ড্রেজার আমদানির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ঘুষ নিয়ে বিল অনুমোদন করেন আইয়ুব আলী। ওই ড্রেজারের একাধিকটি বর্তমানে অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। আইয়ুব আলী ১৯৯২ সালের সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) হিসেবে যোগদান করেন। যান্ত্রিক শাখায় চাকরির সুবাধে অনেক যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম, ভুয়া বিল-ভাউচার ও চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু পরিষদের বিআইডব্লিউটিএ শাখার তিনি নেতা ছিলেন।
আইয়ুব আলীর দুই ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় ও মেয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। ব্যবহার করেন একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি। আইয়ুব আলীর এক ঘনিষ্ঠজন মানবজমিনকে জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায় থাকা দুই ছেলের নামে বাড়ি কিনেছেন। পরিবারসহ প্রতি বছরে দুইবার সেখানে যাতায়াত করেন। এ ছাড়া লন্ডন ও নিউ ইয়র্কে বাড়ি কেনার তথ্য পাওয়া গেলেও তার যাচাই করা যায়নি।
ঠিকাদারদের হামলার শিকার আইয়ুব আলী: নারায়ণগঞ্জে একটি প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আইয়ুব আলী একাধিক ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নেন। পরে নিজের পছন্দসই একজন ঠিকাদারকে ওই প্রকল্পের কাজ দেন। এতে অন্য ঠিকাদাররা ঘুষের টাকা ফেরত চেয়ে তার দপ্তরের গেলে তিনি নিরাপত্তাকর্মী ডেকে তাদের বের করে দিতে বললে ঠিকাদাররা ক্ষুব্ধ হয়ে তার ওপর হামলা চালান। তাকে মারধরের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
মানবজমিনকে যা বলেছেন আইয়ুব আলী: বিআইডব্লিউটি’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আইয়ুব আলীকে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে তিনি প্রথমে প্রতিবেদনের বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। পরে মিটিংয়ে আছেন এবং সন্ধ্যায় কথা বলবেন বলে ফোন রেখে দেন। সন্ধ্যায় ফোন করে সরকারি চাকরি করে কীভাবে নিজে ও পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কিনেছেন এই প্রশ্ন করা হলে তিনি এই প্রতিবেদকের ওপর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করার পরামর্শ দেন। একপর্যায়ে তিনি ফোন কেটে দেন। আইয়ুব আলীর অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে বক্তব্য জানতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্তকর্তাকে ফোন করা হলে তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাননি। বলেন, ‘আমি ওর দায় নিতে পারবো না’।