
রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থা, করপোরেশন ও বিভাগের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বেশ পুরেনো। বিশেষ করে গত দেড় দশকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্প ও কেনাকাটায় বড় ধরনের দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) দপ্তরের নিরীক্ষায় বিভিন্ন সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি ঋণের নামে লুট করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত এক বছরে বেসরকারি ব্যাংক, আর্থিক খাতের অলিগার্কসহ বেসরকারি খাতের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত ও নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, করপোরেশন ও বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি নিরীক্ষা করে দেখার কোনো উদ্যোগ এখানো দেখা যায়নি।
দেশে বর্তমানে ২৩২টি স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ থেকে সরকার সেভাবে কোনো রিটার্ন পাচ্ছে না। বরং এসব প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ দিতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, ৩০ জুন ২০২৪ শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে সরকার।
সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স), তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গত বছরের ২৮ আগস্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি বিনিয়োগকে ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। সরকারি কর্মকাণ্ডের জন্য ক্রয়কৃত পণ্য ও সেবায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। এ অর্থ থেকে ঘুস হিসেবেই চলে গেছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ ঘুস নিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাদের সহযোগী ব্যক্তিরা। এ সময়ে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৭ লাখ কোটি টাকা।
গত ১৫ বছরে অনিয়ম ও লুটপাটের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। এ খাতসংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি, পেট্রোবাংলা, বাপেক্স, তিতাস গ্যাস ও বিপিডিবির বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কোনো ধরনের তদন্ত কিংবা বিশেষ নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার।
শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্তত ৬০০ কোটি ডলার অনিয়ম-দুর্নীতির কথা উঠে আসে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কমিশন, কেন্দ্র না চালিয়ে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ ও অতিরিক্ত মুনাফা হিসেবে এ অর্থ বেসরকারি খাত নিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হয় শ্বেতপত্রে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অতিরিক্ত ব্যয় ও আর্থিক ক্ষতি কমাতে মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন কমিটি করা হলেও আগের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ আইনের আওতায় শতাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এসব প্রকল্পে পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে কমিশন বাণিজ্য হয় বড় আকারে। একই সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে সরকারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের একক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। সংস্থাটি উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে বিশেষ আইনের অধীনে বিগত দেড় দশকে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করেছে। তবে এসব ক্রয় চুক্তিতে বিভিন্ন সময় অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ রয়েছে। আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আরো অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বড় আকারে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ স্বাধীনভাবে তদন্ত করার দাবি ওঠে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর।
দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন সময় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকৃত ব্যয় নিয়ে নিরীক্ষা করার সুযোগ ছিল। ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিভিন্ন সময় কেনাকাটায় কী হয়েছে তার সঠিক তদন্তের দাবিও উঠেছিল। কিন্তু সে রকম কোনো পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকার নেয়নি।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০১০-১১ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত শুধু বিদ্যুতেই ভর্তুকি দিতে হয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি ছিল ক্যাপাসিটি চার্জ। বিদ্যুৎ, জ্বালানির বিশেষ আইন বাতিল করলেও এ আইনের আওতায় হওয়া চুক্তিগুলোয় কী ছিল তা জনগণের সামনে প্রকাশ করার জোর দাবি ওঠে। কিন্তু সরকার সে রকম কিছু করেনি বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সংগঠনগুলো।
দেশের জ্বালানি খাতে ২০১৮ সালের পর এলএনজি আমদানি নিয়ে শুরু থেকে বিতর্ক ছিল। তবে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল এ খাতের কমিশন বাণিজ্য। এ খাতে কারা কমিশন বাণিজ্য করেছে, তা তদন্ত করে দেখার বিষয়টি বার বার আলোচনা হলেও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ এখনো নেই। বিপুল অংকের এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে দেশের গ্যাস খাতের স্থানীয় অনুসন্ধান কার্যক্রম অবহেলায় রাখার পেছনে বড় একটি সিন্ডিকেট কাজ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে পেট্রোবাংলা অর্থ সংকটে থেকেছে বছরের পর বছর।
দেশে জ্বালানি তেল ক্রয়, আমদানি ও বিপণনকাজে নিয়োজিত রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে উল্লম্ফন হলে বিপিসি বিভিন্ন সময় তেলের দাম বাড়িয়েছে। সংস্থাটি লোকসানের কথা বলে তেলের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার কাছ থেকে তা উসুল করেছে। অথচ বিগত সাত-আট বছর কোম্পানিটি বিপুল পরিমাণ লাভ করলেও সে অর্থ দাম কমার সময়ে সমন্বয় করেনি। বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রেখে মুনাফা করেছে সংস্থাটি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বিপিসির আর্থিক মুনাফার বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফার্ম দিয়ে অডিট করার দাবি উঠলেও সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অর্থনৈতিক সমীক্ষার হিসার অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২৩-২৪ (এপ্রিল পর্যন্ত) অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসি প্রায় সাড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে।
গ্রাহক ও গ্যাস সরবরাহে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল)। কোম্পানিটির গ্যাস বিতরণে সিস্টেম লস চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনে বিতরণ করতে গিয়ে এ সিস্টেম লসের (কারিগরি ত্রুটি) নামে বিপুল পরিমাণ গ্যাস অপচয় ও চুরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে বছরে অন্তত ১০০ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে গ্যাসের সিস্টেম লসে। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানির অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তাদের কারণে সিস্টেম লস দেখিয়ে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে। এ চুরি ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হলেও কোনোভাবেই তা কমানো যাচ্ছে না। জ্বালানি বিভাগ থেকে ২০২৬ সালের জুনে তিতাসসহ অন্যান্য কোম্পানির সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে তা কার্যকর হচ্ছে না। গ্যাস খাতে তিতাসের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বৃহদাকারে তদন্তের দাবি উঠলেও সে বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়া যায়নি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স। সংস্থাটি গত দুই দশকে বৃহদাকারে কোনো গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যক্রম চালাতে পারেনি। গ্যাস খাতে বাপেক্সকে বসিয়ে রাখা হয়েছে নাকি বাপেক্সের সক্ষমতা নেই এমন প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল আওয়ামী সরকারের শেষ সময়ে। দেশের গ্যাস খাতে বিদেশী কোম্পানি দিয়ে উচ্চমূল্যে কূপ খননের বড় অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া রিগ ক্রয়, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, সঠিক জরিপ না করে কূপ খনন করে সরকারের আর্থিক দণ্ড নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দুজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, বাপেক্সের সক্ষমতা ও কাজ নিয়ে একধরনের রাজনীতি ও কাদা ছোড়াছুড়ি ছিল সবসময়। বাপেক্স নিজের চেষ্টায় যতটুকু সম্ভব কাজ করেছে। তবে সক্ষমতা অনুযায়ী সংস্থাটিকে বিভিন্ন সময় অকার্যকর করে রাখার বিষয়টি তারা অস্বীকার করেননি।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এ খাতের বকেয়া। তা পরিশোধ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আর্থিক চাপ কমানো হয়েছে। এছাড়া বিশেষ আইন নিয়ে অভিযোগ ছিল। সরকার তা বাতিল করেছে। এর বাইরে বিদ্যুতের ট্যারিফ কমানো, চুক্তি বাতিল, বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটি মূলত ব্যয় ও চুক্তির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে সুপারিশ করেছে। সেগুলো নিয়ে এখনো কাজ চলছে। আর বিগত সরকারের সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বড় আকারে অনুসন্ধানের পরিকল্পনা রয়েছে এ সরকারের।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে আগামীতে অডিটের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এখানে স্থানীয়ভাবে কোনো ফার্মকে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে আরো পর্যবেক্ষণের দরকার। এ খাতের বিভিন্ন চুক্তি ও ক্রয় খতিয়ে দেখার জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি কমিটি করা হয়েছিল। তারা আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে সুপারিশ করেছিল, আমরা একটা আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান খুঁজছি, কিন্তু এখনো কাউকে নিয়োগ দেয়া যায়নি।’
বিগত সময়ে দুর্নীতি, লুটপাটের একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাত। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং বেসমারিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আটটি প্রকল্পে পরিকল্পনা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ত্রুটি, বাস্তবায়নে বিলম্ব ও দুর্নীতির কারণে প্রাক্কলিত বাজেটের চেয়ে ৬৮ শতাংশ বা ৭ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পগুলো হলো পদ্মা সেতু প্রকল্প, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, যমুনা রেল সেতু প্রকল্প, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা এমআরটি লাইন-৬, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প ও বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লাইন-৩ প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলোর প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা পরে বেড়ে ১৮ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এ আট প্রকল্প ছাড়াও এ তিন মন্ত্রণালয় এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আমলে বাস্তবায়ন করা হয়েছে বড় বড় প্রকল্প। বিশ্বের ব্যয়বহুল সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, এক্সপ্রেসওয়ে, রেলপথ নির্মাণ, রেলের ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ, নৌযান-জাহাজ সংগ্রহসহ বিভিন্ন খাতে বাস্তবায়ন করা এসব প্রকল্পের ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চলে গেছে দুর্নীতি ও লুটপাটে।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে (বিএসসি) জাহাজ কেনার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রেও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় দুদকের তদন্তের ওপর নির্ভর করছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা অনুসারে, গত ১৪ বছরে (২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর) সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অধীন বাস্তবায়িত উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণকাজে সর্বনিম্ন ২৯ হাজার ২৩০ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণকাজে সার্বিক দুর্নীতির হার ২৩-৪০ শতাংশ বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
যদিও এসব দুর্নীতি ও লুটপাটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প ভিত্তিতে কিংবা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রনালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এসব বিষয় দুদক তদন্ত করে দেখবে। মন্ত্রণালয় থেকে বা বিভাগ, অধিদপ্তর-দপ্তর থেকে কোনো তদন্ত বা নিরীক্ষার উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেই।’
বিগত সময়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ কেনাকাটা নিয়েও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইজিপ্ট এয়ার (মিসর) থেকে দুটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ লিজে আনে সংস্থাটি। এক বছর পর একটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন বিকল হলে ইজিপ্ট এয়ার থেকেই ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। পরে ওই ইঞ্জিনও নষ্ট হয়ে যায়। সেই ইঞ্জিন মেরামত করতে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রক্রিয়ায় ইজিপ্ট এয়ার ও মেরামতকারী কোম্পানিকে পাঁচ বছরে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা দিয়েছে বিমান। পরে আবার লিজে আনা এ দুই উড়োজাহাজ কিনে নেয় বিমান, যেগুলো ওড়ার বদলে গ্রাউন্ডেডই থাকছে বেশি। আওয়ামী লীগ আমলে বিমানের জন্য কেনা হয়েছে ছয়টি ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ। লিজ অনিয়ম নিয়ে দুদক তদন্ত করলেও নতুন উড়োজাহাজ কেনাকাটা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নিরীক্ষা হয়নি।
আওয়ামী আমলে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। রেল খাতের অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত চিনকি আস্তানা-আশুগঞ্জ ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ সংস্কার প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ ও আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই করে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এসব দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রণালয় কিংবা রেলওয়ের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নিরীক্ষার উদ্যোগ দেখা যায়নি।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংক ও পুঁজিবাজার ছাড়া অন্যান্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনা তা দৃশ্যমান নয়। এমন কোনো পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে কিনা সেটিও তো আমরা জানি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন লোকজনকে পদ থেকে সরানো হয়েছে, এমন কিছু উদ্যোগ আমরা দেখেছি। অবকাঠামো খাতে বিভিন্ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় ও দুর্নীতি হয়েছে। সেগুলো বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের একটি বড় উৎস ছিল সরকারি ক্রয় ও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এগুলো হয়েছে। এগুলোর যদি জবাবদিহি নিশ্চিত করা না যায় তাহলে এর পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাবে না। জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতি করে যাতে কেউ পার না পায় সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।’
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, ‘এমনকি সিএজির নিরীক্ষায়ও বিপুল অংকের যেসব আর্থিক অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে সেগুলোর বিষয়ে কোনো ফলোআপ দেখিনি। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এ বিষয়গুলো দেখা দরকার। এটি শুধু দুদকের একার কাজ না। টাকা কীভাবে গেল, কারা এর জন্য দায়ী সেটা নির্ধারণ করে স্বচ্ছতার সঙ্গে তা জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হলে সংস্কার প্রক্রিয়ার ওপর মানুষের আস্থা অনেক বাড়বে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার পর পরই দেশের এক ডজনের বেশি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়। ওই ব্যাংকগুলোয় সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাট তদন্তে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করা হয়। এরই মধ্যে অন্তত ছয়টি ব্যাংকের ফরেনসিক অডিট ও অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ শেষ হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগও নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বেসরকারি ব্যাংক নিরীক্ষা ও একীভূতকরণের নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে থাকলেও এক্ষেত্রে আলোচনার বাইরে থেকে গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। যদিও ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকে লুণ্ঠন শুরু হয়েছিল। ২০১১ সালে দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তোলে জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে আসে ২০১২ সালে। এর এক বছর পরই আলোচনায় আসে বেসিক ব্যাংক লুণ্ঠনের ঘটনা। একের পর এক বৃহৎ ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে লাখ কোটি টাকারও বেশি লোপাট করা হয়েছে। এ মুহূর্তে কেবল জনতা ব্যাংকেরই মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ যোগ করলে এর পরিমাণ লাখ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তার কিয়দংশও সরকারি ব্যাংকের বিষয়ে নেয়া হয়নি। এ ব্যাংকগুলোর সংস্কার কেবল চেয়ারম্যান-এমডি পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ব্যাংকগুলোর প্রকৃত ক্ষতি নিরূপণে বিশেষ নিরীক্ষা হতে পারত। এটি নিয়ে শুরুর দিকে কিছু আলোচনাও হয়েছিল। তবে কোনো অগ্রগতি হয়নি।’
মুসলিম চৌধুরী আরো বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোয় ফরেনসিক অডিট করছে। এ ব্যাংকগুলোর অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ শেষে একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ ধাপের সফলতার ওপর দ্বিতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোরও নিরীক্ষা হতে পারে।’
সরকারি অর্থে সার আমদানি নিয়ে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে বিসিআইসির বিরুদ্ধে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) দপ্তরের নিরীক্ষায়ও সার ক্রয়ে অনিয়মের বিষয়টি উঠে আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে সার খাতে মোট ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। এর বড় একটি অংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) মাধ্যমে আমদানির জন্য। কিন্তু পরে ধরা পড়ে, ওই বছর শুধু সার পরিবহনকারী ঠিকাদারদের মাধ্যমেই বিসিআইসির প্রায় ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার সার আমদানিতে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ছয় বছরে ৫৭ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সার খাতে ভর্তুকি হিসেবে। বছর বছর ভর্তুকির এ সুবিধার সবটা পৌঁছেনি কৃষকের কাছে। মাঝপথেই এর বড় একটি অংশ লুটে নিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
সরকারের বিদম্যান কাঠামোতেই এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে নিরীক্ষা ও পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ নিজ উদ্যোগেই তা করতে পারে বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বিগত সরকারের সময়ে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে সে বিষয়ে মোটাদাগে মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরেছে। এর ভিত্তিতে চাইলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার নেতৃত্বেই ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করার ক্ষমতা আছে এবং এজন্য বাজেটে অর্থও বরাদ্দ থাকে। পাশাপাশি এসব বিষয় দেখা সিএজিরও সাংবিধানিক দায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অনুরোধে কিংবা নিজেরাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিএজি এটি দেখতে পারে। জেনেশুনে অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে কোনো অনিয়ম করা হলে সেটি ফৌজদারি অপরাধ, যা দেখাটা দুদকের দায়িত্ব। অন্যদিকে অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্য না থাকলেও অবহেলা, অযোগ্যতা, অসাবধানতার কারণে যদি এমন কোনো কাজ করা হয় যাতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে তাতেও এ ধরনের অনিয়মের জন্য নিরীক্ষা করে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।’