
বগুড়ায় বিভিন্ন নামে ভুয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা, সামাজিক ও মানবিক সেবামূলক ফাউন্ডেশন গড়ে তুলে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে সোহেল মণ্ডল, ভোলানাথ পাল ও আবুল কালাম আজাদ গং। ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে সনদ বিক্রি ও ফাউন্ডেশনের ব্যানারে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তারা। আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে এসব ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের নামে বাণিজ্য চালিয়ে এলেও এতদিন তা প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু গত ২৫ জুলাই গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নেওয়া হলে বেরিয়ে আসে তাদের অপকর্মের চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানা যায়, সরকারি অনুমোদন ছাড়াই ২০১৫ সাল থেকে ‘প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটি’ নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে চলছিল প্রতারণা ব্যবসা। চক্রটি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ভুয়া সনদ দিয়ে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে দুদকের গণশুনানিতে তাদের ডাকা হয়। শুনানিতে তারা কোনো তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। পরে দুদক তাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়। আদালত অপরাধীদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দেয়। রিমান্ডে বেরিয়ে এসেছে অপকর্মের এসব ঘটনা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া এলাকায় সোহেল ও সহযোগী ভোলানাথ ভুয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যানার টানিয়ে সার্টিফিকেটবাণিজ্য করতেন তারা। প্রতারক সোহেল মণ্ডল কথিত ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার ও চারুকলা ডিপ্লোমা ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক পরিচয় দিতেন। আর সহযোগী ভোলানাথ নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যক্ষ ও উপ-উপাচার্য পরিচয় দিতেন। এ পর্যন্ত তারা এক হাজারের অধিক সনদ বিক্রি করেছেন। বিগত দিনে আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বিঘ্নে তারা এসব অপকর্ম চালিয়ে গেছেন।
অথচ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তালিকায় বগুড়ায় এ নামের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য নেই। অনুমোদন না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষাকার্যক্রম সম্পূর্ণ অবৈধ। গত ২৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের সর্বশেষ পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। সূত্রটি জানায়, তাদের সনদবাণিজ্যের টাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের পকেটে যেত। সে কারণেই এই ব্যবসা নির্বিঘ্নে চালিয়ে গেছে তারা। তদন্তের স্বার্থে পুলিশ আওয়ামী নেতাদের নাম বলছে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের কাটনারপাড়ার একটি ক্লিনিকের পাশে জরাজীর্ণ ভূতুড়ে ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম চলছিল। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে আসলে কী চলছে। ফটকে নেই কোনো সাইনবোর্ড, শুধু পোস্টার টাঙানো রয়েছে। নামমাত্র এসব পরীক্ষা শেষে দেওয়া হতো উচ্চতর ডিগ্রির ভুয়া সনদ। বগুড়ার বাইরের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সুবিধামতো ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ ব্যাপারে অধিকতর তদন্ত চলছে এবং ইতোমধ্যে পুলিশের কাছে শতাধিক অভিযোগ এসেছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের মামলার আসামি আমেনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ১৬ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে বগুড়ার মাদলা নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত তার নির্মাণাধীন আমেনা ডেইরি ফার্মের অফিস থেকে তাকে আটক করা হয়। বগুড়া জেলা জজকোর্টের অধীন প্রতারণামূলক অর্থ আত্মসাৎ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সদর থানার এসআই নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম এ অভিযান পরিচালনা করে।
জানা যায়, আবুল কালাম আজাদ ও তার স্ত্রী (যিনি আমেনা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক) উভয়ের নামে বগুড়া, গাইবান্ধা, গোবিন্দগঞ্জ ও জয়পুরহাট আদালতে অনেকগুলো প্রতারণার মামলা চলমান। এমনকি জয়পুরহাট জেলা জজকোর্টে তার বিরুদ্ধে একটি মাদক চোরাচালান মামলাও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত কয়েক বছর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজেক্ট ও অনুদান এনে দেওয়ার নাম করে তিনি এনজিও, ফার্ম ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা প্রতারণা করে আত্মসাৎ করেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দুজন এমপি ও কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় প্রতারণার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন আজাদ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরও তিনি নতুন কৌশলে প্রতারণা ব্যবসা চালু রাখেন। তিনি ‘পরিবেশ’ নামের একটি পত্রিকা বের করতেন।
জানা গেছে, একসময়কার ডাকহরকরার ছেলে গত ১৫ বছরে বগুড়ায় দুটি বহুতল ভবন, তিনটি খামারের জমি, গোবিন্দগঞ্জে সাত বিঘা জমি, ঢাকায় দুটি দামি ফ্ল্যাটসহ রংপুর, ফরিদপুর, রাজশাহী ও গাইবান্ধায় একাধিক বাড়ির মালিক হয়েছেন।
অভিযোগকারীদের সূত্রে জানা গেছে, এ বিপুল সম্পদ অর্জনের সূত্র খুঁজে না পেয়ে স্থানীয় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে- আমেনা ফাউন্ডেশন, যেখানে কোনো স্টাফ নেই, দেশি-বিদেশি উন্নয়ন প্রকল্প নেই, শুধু সাইনবোর্ডনির্ভর অফিস, সেখান থেকে কীভাবে তিনি ও তার স্ত্রী এত সম্পদের মালিক হলেন।
সচেতন মহল মনে করছে, প্রকৃত বিচার ও প্রতারণায় লুণ্ঠিত অর্থ উদ্ধারের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। শিক্ষা ও স্বেচ্ছাসেবী ফাউন্ডেশনের নামে প্রতারণা বন্ধ হওয়া দরকার। জড়িতদের শাস্তি হওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এভাবে মানুষ ঠকানোর সাহস না পায়।