
জুলাই বিপ্লবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
গতকাল সোমবার গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ তিনজনের সাক্ষ্য নেন।
সাক্ষীদের মধ্যে আশুলিয়ায় হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া শহীদ আস-সাবুরের বাবা এনাম নাজেজ জাকী ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, ‘আমার নিরপরাধ ছেলেকে শেখ হাসিনাসহ আসামিরা যেভাবে হত্যা করে বীভৎস কায়দায় পুড়িয়েছে, আমি তাদেরও সে রকম শাস্তি চাই।’
এ সময় নাজেজ জাকী বাদে অন্য দুজন সাক্ষী হলেন যাত্রাবাড়ীর রবিউল আওয়াল ভূঁইয়া ও রাজশাহীর জসিম উদ্দিন।
ট্রাইব্যুনালে এনাম নাজেজ জাকী বলেন, ‘৫ আগস্ট, সকাল ১০টার দিকে আস-সাবুর বাসা থেকে বেরিয়ে মিছিলে যোগ দেয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সে বড় ভাইকে ফোন করে জানায় আশুলিয়া জামগড়া এলাকায় পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করছে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হচ্ছে। তার ভাই তাকে দ্রুত বাড়িতে চলে আসতে বললেও সে আসেনি। পরে তারা মিছিল নিয়ে আশুলিয়া থানা এলাকায় গেলে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করে। বিকেল ৪টার পর থেকে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আমরা আর পাইনি। পরদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক ইমরান আমাদের ফোন করে জানান, আশুলিয়া থানার সামনে তার লাশ পোড়ানো রয়েছে।’
জুলাই বিপ্লবে যাত্রাবাড়ীর কাজলায় শহীদ হন ইমাম হাসান তাইম। সে নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজী নগর এমডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। গতকাল তার বড় ভাই রবিউল আউয়াল ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ‘২০ জুলাই ইমাম হাসান দুপুর ১২টায় কারফিউ শিথিল হলে চা খাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তারপর বন্ধুদের নিয়ে কাজলা এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেন। দুপুর প্রায় ১২টা ৫০ মিনিটের সময় আমাদের বাড়িওয়ালা হঠাৎ এসে জানান ইমাম হাসানকে গুলি করার খবর পাওয়া গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার আম্মা কাজলা ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখতে পায় রাস্তায় প্রচুর রক্ত। ইমাম হাসান তাইমের জুতাগুলো রাস্তায় তখনো পড়ে আছে।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে রবিউল জানান, তাইমকে একটি রিকশা করে কিছু পুলিশ যাত্রাবাড়ী থানার দিকে নিয়ে গেছে। তার আগে কাজলা ব্রিজের কাছে ছাত্ররা মিছিল শুরু করলে পুলিশ যাত্রাবাড়ী থানা থেকে বের হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা শুরু করে। এতে ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে তাইমসহ কয়েকজন বন্ধু কাজলা ব্রিজের পাশে লিটন চা স্টলে আত্মগোপনের চেষ্টা করে। কিন্তু কয়েকজন পুলিশ তাদের টেনেহিঁচড়ে বাইরে আনে। এরপর গালিগালাজ ও লাঠিপেটা করে।
এ সময় পুলিশ সদস্যরা তাদের দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে বললে সরল বিশ্বাসে তাইম দৌড় দিলে পুলিশ তার পায়ে গুলি করে। এরপরই তার পেটের নিচে আবারও গুলি করা হয়, যা তলপেট ছিদ্র হয়ে অপর দিকে বের হয়ে যায়। হতচকিত এ ঘটনায় তাইম একটু পেছন ফিরলে আরেক পুলিশ সদস্য তাকে কাছ থেকে শটগানের গুলিতে ঝাঁজরা করে দেয়। এ সময় তার বন্ধু রাহাত তাইমকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে উন্মত্ত পুলিশ সদস্যরা তাকেও গুলি করে। এ অবস্থায় তাইম প্রায় আধা ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে থাকে। এ সময় উপস্থিত এক সাংবাদিকসহ কয়েকজন তাকে হাসপাতালে পাঠাতে উদ্যত হলে পুলিশ সদস্যরা বাধা দেয়। যেন এসব পুলিশ সদস্য তার যন্ত্রণাময় মৃত্যু উপভোগ করছিল।
রবিউল বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ২০০ গজের মধ্যে দুটি হাসপাতাল থাকলেও পুলিশ তাকে কোনো হাসপাতালে নিতে দেয়নি। পরে তার অর্ধমৃত দেহটি রিকশা করে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নিয়ে আসে। এরপর গুলিতে ঝাঁজরা তার দেহটি রাস্তায় ফেলে কিছু পুলিশ সদস্য বুট জুতা দিয়ে তার চেহারা ও শরীর থেতলে দেয়।
এরপর তাইমের শরীর যখন পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে যায় তখন তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাইমকে মৃত ঘোষণা করেন। তাইমকে মারার ভয়াবহ ভিডিও পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
তাইমের বড় ভাই বলেন, বিভিন্ন ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শী মারফত আমরা জেনেছি নৃশংস এ ঘটনার নেতৃত্বে ছিল তৎকালীন পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী ও প্রলয় কুমার। ছাত্র-জনতা ও তাইমকে তখন প্রথম পায়ে গুলি করে যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক সাজ্জাদুজ্জামান।
এরপর ঘটনাস্থলে উপস্থিত অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শামীম অন্য পুলিশ হতে দ্রুত একটি অস্ত্র নিয়ে তাইমকে দ্বিতীয়বার গুলি করেছিল, যা তার তলপেট ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। এরপরে যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাকির হোসেন তাইমের শরীর লক্ষ্য করে শটগানের গুলিতে পুরো শরীর ঝাঁজরা করে দেয়। দেখা যায় প্রায় দুই শতাধিক স্প্লিন্টার তার শরীরে রয়েছে।
গতকাল ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত বিচারিক প্যানেল মোট তিনজন সাক্ষীর জবানবন্দি শোনেন। প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারপতি মহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আদালতে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম এ বিষয়ে শুনানি করেন।