Image description
মেয়াদ বাড়ে, ব্যয় ফুলে-ফেঁপে গায়েব হয় রাষ্ট্রের টাকা পাঁচ বড় রেলওয়ে প্রকল্পের ৪৩% টেন্ডার সময়মতো শেষ হয়নি

২০১৭ সালের শেষ দিকে ঢাকার কমলাপুর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এএফকনস-কেরালা পিডব্লিউডি জয়েন্ট ভেঞ্চারের সঙ্গে এক হাজার ৩৯৪ কোটি টাকার চুক্তি হয়। পরিকল্পনা ছিল তিন বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ২০২১ সালের জুনে কাজ শেষ হবে। কিন্তু সময়সীমা পেরিয়ে গেছে চার বছর, চার দফায় মেয়াদ বেড়েছে সাড়ে চার বছর। এত বিলম্বের পরও অগ্রগতি মাত্র ৫৮ শতাংশ।

আশ্চর্যের বিষয় এক টাকাও ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা আদায় হয়নি; বরং বারবার সময় বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্প ব্যয়ও বেড়েছে বিপুল হারে, যা রেলওয়ের বড় প্রকল্পগুলোর সার্বিক চিত্রের প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশ সরকারি ক্রয় কর্তৃপক্ষের (বিপিপিএ) সর্বশেষ পোস্ট প্রকিউরমেন্ট পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, পাঁচটি বড় রেলওয়ে প্রকল্পের ৪৩.৩৩ শতাংশ টেন্ডারের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। বিলম্ব হয়েছে ২১১ দিন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক হাজার ৫৯৮ দিন পর্যন্ত।

৯ হাজার ২১ কোটি টাকার ৩০টি টেন্ডার পর্যালোচনায় গুরুতর নিয়ম লঙ্ঘনের প্রমাণ মিলেছে। কোথাও বিজ্ঞাপন প্রকাশের প্রমাণ নেই, কোথাও ব্যয় নির্ধারণ কমিটি গঠনের আদেশ অনুপস্থিত আবার অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক চেকলিস্টও নেই। আইনি সময়সীমা পেরিয়ে টেন্ডার মূল্যায়নের নজিরও রয়েছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চুক্তিতে।

জানা যায়, রেলওয়ের প্রকল্পে অপচয়, অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়।

বছরের পর বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানের ক্রয় ও কাজে পুকুর চুরির অভিযোগ রয়েছে। অথচ এত বিপুল খরচের পরও রেলের সেবার মান বাড়েনি। উল্টো রেল চলেছে পেছনের দিকে। একটি রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানের যেখানে এত দিনে বিশ্বমানে পৌঁছানোর কথা, সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের পর এর সেবার মান রয়ে গেছে তলানিতে। উল্লিখিত প্রকল্পগুলোর অনিয়ম আর দুর্নীতি দেখলেই তার প্রমাণ মেলে।

সূত্র বলছে, রেলওয়ে তাদের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা নিয়মমাফিক হালনাগাদ করেনি। ত্রৈমাসিক আপডেটের কোনো রেকর্ডও নেই। এমনকি বাধ্যতামূলক অভ্যন্তরীণ পরবর্তী ক্রয়-পর্যালোচনাও হয়নি। বিপিপিএর প্রতিবেদনে সময়সীমা কঠোরভাবে মানা, অযৌক্তিক বিলম্বে ক্ষতিপূরণ জরিমানা আরোপ, একই প্রকল্পে বারবার সময় বাড়ানো বন্ধ করা এবং ক্রয়প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে ই-জিপি পুরোপুরি চালুর সুপারিশ করা হয়েছে।

বিপিপিএর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রকল্প বিলম্বের নজির শুধু কমলাপুর-জয়দেবপুরে সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রুটের এসডি-১ প্যাকেজ অনুমোদন পায় ২০১২ সালে, শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালের জুনে। কিন্তু নানা জটিলতায় সময়সীমা এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২০২৭ সালের জুনেমোট এক হাজার ৩৮৬ দিন অতিরিক্ত। ব্যয়ও বেড়েছে কয়েক গুণ, ৮৪৯ কোটি টাকা থেকে প্রায় তিন হাজার ৩৪৩ কোটি টাকায়।

দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পের লট-১ অংশ শুরু হয় ২০১৭ সালে, শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে। কিন্তু ১২ বার সময় বাড়িয়ে নতুন সময়সীমা ধরা হয় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর; তাতেও কাজ শেষ হয়নি, অগ্রগতি মাত্র ৯০ শতাংশ। একই প্রকল্পের লট-২ অনুমোদন পায় ২০১০ সালে, তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ৯ বার সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে, ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০ গুণএক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৩৩৬ কোটিতে।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী, কিছু অসাধু প্রকল্প কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের যোগসাজশে সময় ও ব্যয় দুই-ই বেড়েছে। জনতার টাকায় হয়েছে অপচয়। ফলে প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ খরচ দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি, কখনো ইউরোপের চেয়েও দ্বিগুণ।

তিনি আরো বলেন, এই অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে রেলওয়ে প্রকল্পের ব্যয় অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে এবং প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা ক্ষীণ। পাশাপাশি সরকারি তদারকি কার্যকর না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয়ের অসংগতি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যয়বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন বলেন, আমরা এরই মধ্যে একাধিক প্রকল্পে সময়সীমা অতিক্রম, ব্যয় বৃদ্ধি ও অনিয়মের বিষয় শনাক্ত করেছি। এটি সত্যি যে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে। সরকার এখন পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালা আরো কঠোরভাবে প্রয়োগে যাচ্ছে। কোনো প্রকল্পে অযৌক্তিক বিলম্ব হলে দায়ী কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা চাই প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হোক, ব্যয় যেন আর অকারণে ফুলে-ফেঁপে না ওঠে।

তিনি আরো বলেন, ক্রয়প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা আনার জন্য ই-জিপি শতভাগ চালু করা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বশীলতা ও সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করতে আইএমইডি থেকে ঘন ঘন মনিটর করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, আমি এখনো বিপিপিএর রিপোর্টটি হাতে পাইনি। সেটা পেলে দেখে বলতে পারব।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রেলওয়ে খাতের এই প্রকল্প বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধির চিত্র শুধু সময় ও অর্থ অপচয় নয়, এটি রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থাপনায় গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গেরও প্রমাণ। সাধারণ জনগণ ও করদাতাদের টাকা নিয়ন্ত্রিত ও স্বচ্ছ ব্যবস্থায় ব্যয় না হলে ভবিষ্যতের বড় প্রকল্পগুলোও অনন্ত বিলম্ব ও অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধির ফাঁদে আটকে থাকবে। তাঁরা আরো বলছেন, সুপারিশ অনুযায়ী কড়াভাবে নিয়ম প্রয়োগ, অভ্যন্তরীণ তদারকি ও ই-জিপি ব্যবস্থার সম্পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।