
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে চলন্ত অবস্থায় এক মাইক্রোবাস চালকের চোখে ঘুম নেমে আসে। ওই অবস্থায় গাড়ি চালানো অব্যাহত রাখলে একপর্যায়ে মাইক্রোবাসটি সড়ক থেকে ছিটকে খালে পড়ে। এতে একই পরিবারের সাতজন নিহত হন। নিহতরা সবাই নারী ও শিশু। গত ৬ আগস্ট ভোরে ওমান প্রবাসী এক স্বজনকে নিয়ে ঢাকা থেকে লক্ষ্মীপুরে ফেরার পথে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনাটি ঘটে। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন বেগমগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিটন দেওয়ান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছি চালক এনায়েত হোসেন মাইক্রোবাসটিকে মূল সড়ক থেকে নিচে নামিয়ে অন্তত ৫০ গজ অগ্রসর হয়ে সোজা খালে নামিয়ে দেয়। চলন্ত অবস্থায় তার চোখে ঘুম থাকায় এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানতে পেরেছি।’
সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের পাশে গত ৬ আগস্ট দুপুরে যাত্রীবাহী বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও সুনামগঞ্জ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের দুই শিক্ষার্থী। মুখোমুখি সংঘর্ষের উভয় যানবাহনই ছিল ফিটনেসবিহীন। যাত্রীবাহী বাসটির ফিটনেস ২০২৫ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত ছিল; আর ২০১৭ সালের ৭ নভেম্বরের পর থেকে সিএনজির ফিটনেস নবায়ন হয়নি।
শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়- প্রতিনিয়তই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ। ফলে ক্রমেই বাড়ছে সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী-২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৫৯ হাজার ৫৯৭ জন। এর মধ্যে শুধু ২০২৪ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ২৯৪ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১২ হাজার ১৯ জন।
বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত যানবাহন ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার। এর মধ্যে ফিটনেস সনদ থাকা বাধ্যতামূলক যানবাহনের সংখ্যা ১৭ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ছয় লাখের হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই। ফিটনেসবিহীন এবং পুরোনো হয়ে যাওয়া যানবাহনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা এলেও তা সফলতার মুখ দেখে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ চালকের অসুস্থতা, অবসাদ, ক্লান্তি ও যানবাহনের ফিটনেস না থাকা। এছাড়া বেশির ভাগ গাড়িতে সেফ সিস্টেম এপ্রোচ না থাকায় দুর্ঘটনায় বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, আমাদের দেশের গাড়িচালকদের অর্ধেকের বেশি অসুস্থ। তাদের কারও স্বল্প দৃষ্টি, হাই ব্লাডসুগার আবার কেউ উচ্চ রক্তচাপ সমস্যায় ভুগছেন। অন্যদিকে বিআরটিএ’র (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখের বেশি।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালক ও যানবাহনের বেহাল দশায় সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবরই উদাসীন। কার্যকর ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিলে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তারা। দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সেইফ সিস্টেম এপ্রোচে গুরুত্বের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সেইফ সিস্টেম এপ্রোচ হলো সড়ক নিরাপত্তা উন্নত করার একটি পদ্ধতি, যা মানুষের ভুল করার প্রবণতা এবং ত্রুটিপূর্ণ অবকাঠামো উভয়কেই বিবেচনা করে।
পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সমস্যা রেগুলেটরি অথরিটিকে (নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ) নিয়ে। আমরা সড়কে যে অরাজকতা দেখি তা মূলত তাদের অদক্ষতা এবং অকার্যকর কর্মযজ্ঞের ফল।
জানতে চাইলে বিআরটিএ’র উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মাসুম বিল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, লাইসেন্স দেওয়া এবং নবায়নের ক্ষেত্রে চালকদের স্বাস্থ্যগত বিষয় দেখা হয়। এছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে।
সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি যেন মৃত্যুফাঁদ : লক্কড়ঝক্কড় ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে পরিত্রাণের উপায় মিলছে না। বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরযান ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার। এর মধ্যে গণপরিবহণ হিসাবে ব্যবহৃত বাস, মিনিবাস ও হিউম্যান হলারের সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার ৬৬৮। দেশজুড়ে ব্যবহৃত এসব গণপরিবহণের অধিকাংশেরই নেই হালনাগাদ ফিটনেস সনদ। পরিবহণ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিটনেসবিহীন এসব গণপরিবহণ সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলাচল করায় ঝুঁকিতে পড়ছে যাত্রী নিরাপত্তা। দুর্ঘটনার পাশাপাশি সড়কে বিশৃঙ্খলা-যানজটের কারণও হয়ে দাঁড়াচ্ছে এসব গণপরিবহণ।
সম্প্রতি পরিবহণ খাতের উন্নয়নবিষয়ক এক সভা অনুষ্ঠিত হয় বিদ্যুৎ ভবনে। সেখানে উপস্থাপন করা তথ্য বলছে, গণপরিবহণ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশে এমন বাসের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৭৩৩। মিনিবাস রয়েছে ২৮ হাজার ৫৬১টি। আর ১৭ হাজার ৩৭৪টি হিউম্যান হলার। এর মধ্যে ভাড়ার বিনিময়ে নির্দিষ্ট রুটে যাত্রী পরিবহণে ব্যবহৃত ২৩ হাজার ৬৬৫টি বাস, ১১ হাজার ৯০৫টি মিনিবাস ও ১৪ হাজার ৫১০টি হিউম্যান হলারের হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই। এছাড়া এক লাখের বেশি গণপরিবহণ ছাড়াও দেশে নিবন্ধিত চুক্তিভিত্তিক পরিবহণ হিসাবে ব্যবহৃত অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও ট্যাক্সিক্যাবের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে অটোরিকশা তিন লাখ ২৭ হাজার, অটোটেম্পো ১৬ হাজার ও ট্যাক্সিক্যাব রয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, চুক্তিভিত্তিক পরিবহণ হিসাবে ব্যবহৃত দুই লাখ ২৩ হাজারের বেশি মোটরযানের হালনাগাদ ফিটনেস নেই। সবচেয়ে বেশি ফিটনেসবিহীন অবস্থায় রয়েছে অটোরিকশা। সারা দেশে প্রায় দুই লাখ ১১ হাজারেরই নেই হালনাগাদ ফিটনেস।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. শামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, প্রতি বছর যদি গাড়ির ফিটনেসের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হতো তাহলে এ পরিস্থিতি হতো না। তিনি বলেছেন, গাড়ির বয়সসীমার ভিত্তিতে ফিটনেস সনদ দেওয়া বিজ্ঞানসম্মত নয়। অনেক গাড়ি ১০ বছর ব্যবহার হলেও তা আনফিট হতে পারে। আবার যত্ন নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করলে ৩০ বছর পরও কোনো গাড়ি ফিট থাকতে পারে।
বেশির ভাগ চালক অসুস্থ : সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসছে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য সেক্টর। সম্প্রতি তারা ৮২৯ জন চালকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে। সেখানে দেখা গেছে, চোখের দৃষ্টিগত সমস্যায় ভুগছেন ৫৪১ জন চালক অর্থাৎ শতকরা হিসাবে ৬৫ ভাগ। এ ছাড়া ব্লাডপ্রেশারের সমস্যায় ভুগছেন ৩৫ ভাগ এবং ব্লাডসুগার সমস্যা রয়েছে ৫০ ভাগ চালকের। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এমন তথ্য পায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। এসব চালকের দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।
গত ৩০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন রুটে বাস ও ট্রাক চালান যশোরের বাসিন্দা আসলাম মোল্লা। তার ব্লাডসুগার, ব্লাডপ্রেশার, চোখের পাওয়ার ঠিক আছে কিনা তা কখনো পরীক্ষা করাননি। শরীরে কোনো জটিলতা আছে কিনা তাও জানা নেই। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নে তিনি কোনো বাধার মুখে কখনোই পড়েননি বলে দাবি করেন। তিনি নিজেই স্বীকার করেন, লাইসেন্স নবায়নের জন্য কখনো মেডিকেল টেস্ট করা লাগেনি তার। এমন বাস্তবতায় অনেক চালক জানেনই না তাদের শরীরে কোনো সমস্যা আছে কিনা।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, অন্যান্য দেশের চালকদের কর্তৃপক্ষের কাছে বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয়, ফিট হলেই তারা গাড়ি চালাতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে এগুলো কখনোই গুরুত্বসহকারে নেওয়া হয় না। আমাদের দেশের চালকদের বার্ষিক বা ছয় মাস অন্তর স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়টি আইনের মধ্যে আনা উচিত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (বিভাগীয় প্রধান) ডা. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন যুগান্তরকে জানান, আমাদের দেশের অধিকাংশ ড্রাইভারের ব্লাডসুগার হাই অর্থাৎ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যাদের সুগার হাই তাদের হঠাৎ মাথা ঘোরায়, হাত পা কাঁপার প্রবণতা থাকে। গাড়ি চালানো অবস্থায় যদি হঠাৎ ব্লাডসুগার হাই হয় তখন শরীরের ব্যালেন্স রাখতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, হঠাৎ প্রেশার হাই হয়ে গেলেও শরীরে একই ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। অর্থাৎ মাথা ঘোরে, হাত পা ঝিমঝিম করে, সামনে কিছু দেখতে পায় না, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তখনই মূলত দুর্ঘটনাগুলো ঘটে।