
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি অদ্ভুত বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে। একদিকে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে স্বস্তির ইঙ্গিত মিলছে। অপরদিকে টানা তৃতীয় বছরের মতো মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাস শিল্প খাতে মন্দা ও বিনিয়োগ স্থবিরতার স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একদিকে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে স্বস্তি থাকলেও অপরদিকে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাস ও বিনিয়োগ স্থবিরতা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন নীতিগত স্থিতিশীলতা, সুদের হার নিয়ন্ত্রণ, আমদানি সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, “বৈদেশিক লেনদেনে স্বস্তি যতটা ইতিবাচক মনে হচ্ছে—শিল্প খাতে যন্ত্রপাতি আমদানির ধস ঠিক ততটাই উদ্বেগজনক।”
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, এ সময়ে এলসি নিষ্পত্তিও একই হারে কমেছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে নতুন শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি আরও শ্লথ হয়ে পড়বে।
যন্ত্রপাতি আমদানির ধস
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদায়ী অর্থবছরে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৫ দশমিক ৪২ শতাংশ, আর এলসি খোলা কমেছে ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। সহায়ক শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ১ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং এলসি খোলা কমেছে দশমিক ৫১ শতাংশ।
খাতভিত্তিক অবস্থা
শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানিতে সর্বাধিক অংশীদার গার্মেন্টস, বস্ত্র ও ওষুধশিল্প। এ তিন খাত মোট আমদানির প্রায় ৬০ শতাংশজুড়ে রয়েছে। এর মধ্যে শুধু গার্মেন্টস খাতেই আমদানি বেড়েছে—১২ দশমিক ৪১ শতাংশ, এলসি খোলা বেড়েছে ৩ দশমিক ৮১ শতাংশ। বিপরীতে বস্ত্র খাতে আমদানি কমেছে ২৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং ওষুধশিল্পে কমেছে ৩৫ দশমিক ২৭ শতাংশ।
চামড়াশিল্পে আমদানি বেড়েছে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, তবে এলসি খোলা কমেছে ৪৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। পাট, প্যাকেজিং, কৃষিযন্ত্র, কম্পিউটারসহ অন্যান্য খাতেও আমদানি ও এলসি খোলায় উল্লেখযোগ্য পতন হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে একটি শিল্প গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “এলসি খোলার প্রবণতা কমে যাওয়ায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে নতুন বিনিয়োগে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে।”
কাঁচামাল আমদানির প্রবণতা
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সার্বিক কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যদিও এলসি খোলা সামান্য কমেছে। তবে এই প্রবৃদ্ধির মূল অবদান রফতানিমুখী শিল্প থেকে এসেছে। এ খাতে কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ১৮ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং এলসি খোলা বেড়েছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। অপরদিকে, ভোজ্যতেল, তুলা, ওষুধ ও ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে।
বিনিয়োগ স্থবিরতার ইঙ্গিত
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের ( সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, “মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির পতন স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়—নতুন বিনিয়োগে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কমছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানে।”
মুদ্রানীতিতে চাপ
টানা চার বছর ধরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট ও ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ, যা লক্ষ্য ৯ দশমিক ৫ শতাংশের অনেক নিচে। জুন মাস শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ঠেকেছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রবৃদ্ধির এই ধারাবাহিক নিম্নগতি অর্থনীতিতে বিনিয়োগ স্থবিরতার সংকেত দিচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ সুদ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সংকোচনশীল মুদ্রানীতির কারণে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তিনি মন্তব্য করেন, “মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিও কমেছে, যা কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আমি এটাকে একটা দুশ্চিন্তা হিসেবে দেখি।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা কমেছে ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর ফলে নতুন শিল্পে বিনিয়োগের গতি আরও মন্থর হয়েছে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসলেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্বস্তি কাটেনি।’ তার মতে, আসন্ন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা তখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। জুনে এসে তা নেমেছে রেকর্ড নিম্নে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নীতি সহায়তা নিয়ে অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক জটিলতা এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস ঘাটতি ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আলী বলেন, “মনে হচ্ছে উদ্যোক্তারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুদের হার কমার জন্য অপেক্ষা করছেন।” ব্যবসায়ীদের মতে, অপ্রতুল ইউটিলিটি পরিষেবা, প্রশাসনিক জটিলতা ও নীতি সহায়তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বিনিয়োগে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “উচ্চ সুদ, গ্যাস সংকট আর কঠোর নীতির কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে কম ঋণ নিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা লোকসান মাথায় নিয়ে নতুন বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে চান না।”
এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, “সাধারণত যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়া মানে অর্থনীতি এগোচ্ছে। কিন্তু এখনকার প্রবণতা উল্টো সংকেত দিচ্ছে—এটি নিম্ন প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে শ্লথগতির প্রতিফলন।’’
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বেকারত্ব বাড়বে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
তথ্যমতে, ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে জুলাইয়ে অস্থিরতা শুরু হয় এবং ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি দ্রুত নিম্নমুখী হতে থাকে। জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ, আগস্টে তা নেমে যায় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে। এরপর সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ, অক্টোবরে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, নভেম্বরে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে কমে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ।
শিল্প খাতের দীর্ঘমেয়াদি মন্দা
২০২০ সালের করোনা মহামারির পর থেকেই শিল্প খাতে মন্দা প্রকট হয়। এরপর বৈশ্বিক মন্দা, ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, ব্যাংক খাতে তারল্য ঘাটতি ও উচ্চ সুদের হার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বেসরকারি বিনিয়োগে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তারল্য সংকট দেখা দেয়। একই সময়ে ঋণের সুদের হার ৮-৯ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২-১৮ শতাংশে।
কাঁচামাল আমদানি: দ্বৈত চিত্র
বিদায়ী অর্থবছরে সার্বিক কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। তবে এ প্রবৃদ্ধির মূল অবদান এসেছে রফতানিমুখী শিল্প থেকে। এ খাতে কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ১৮ দশমিক ৬২ শতাংশ, এলসি খোলা বেড়েছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।
অপরদিকে ভোজ্যতেল, তুলা, ওষুধ ও ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। অর্থাৎ, কাঁচামাল আমদানির প্রবণতা দেখাচ্ছে—রফতানিমুখী শিল্পে কিছুটা গতি থাকলেও অভ্যন্তরীণ চাহিদানির্ভর শিল্পগুলো সংকটে রয়েছে।
বৈদেশিক লেনদেনে আপাত স্বস্তি
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ কম। এ সময়ে রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৬৪ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি মাত্র ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো—বিদায়ী অর্থবছরে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে ১৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অথচ আগের অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি ছিল ৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় এ সাফল্য এসেছে। এছাড়া আর্থিক হিসাবেও ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মে পর্যন্ত সময়ে এ খাতে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিচ্ছেন— আমদানি কমে যাওয়ার কারণে এ ভারসাম্য তৈরি হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক নয়।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত এখন যতটা ইতিবাচক মনে হচ্ছে, বিনিয়োগের পরিবেশ বদলালে আমদানি বেড়ে যেতে পারে। তখন আবার চাপ তৈরি হবে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে।” তিনি বলেন, “বিওপি’র উন্নতি আপাতত স্বস্তিদায়ক মনে হলেও এর পেছনে নেতিবাচক কারণও আছে। আমদানি প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশেরও কম, যা বিনিয়োগ স্থবিরতার প্রতিফলন। দীর্ঘমেয়াদে এটা অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত।”
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘‘রেমিট্যান্স বৃদ্ধির পেছনে নীতিগত পরিবর্তন নয়, বরং রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব বেশি কাজ করেছে। হুন্ডি বাজারে ভাটা পড়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাহ বেড়েছে। তবে এই প্রবণতা কতটা স্থায়ী হবে—তা নির্ভর করছে আগামী দিনের নীতিনির্ধারণের ওপর।”