Image description
মেগাপ্রকল্পের দুর্নীতি অনুসন্ধানে অনীহা

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)র চোখ সম্পদের দিকে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান-তদন্তে অধিক আগ্রহ দেখাচ্ছে সংস্থাটি। শেখ হাসিনার মাফিয়া যুগে মেগা প্রকল্পের আড়ালে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট এবং পাচার হয়েছে সেগুলো অনুসন্ধান-তদন্তে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে ধীরগতি। অনুসন্ধান শুরুর তথ্য প্রচার করা হলেও ‘শেষ’র সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের মামলা ঠুকেই দায় সারছে দুদক। পক্ষান্তরে ক্রমশঃ ফিকে হতে চলেছে বিদ্যুৎ সেক্টরসহ বিভিন্ন খাতে মেগাপ্রকল্পে লুটপাটের যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর বিচার, লোপাটকৃত অর্থ পুনরুদ্ধার এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সম্ভাবনা। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা রাঘব বোয়ালদের ধরেেত কমিশনের অনীহা, সৎ সাহসের অভাব, ‘পিক অ্যান্ড চ্যুজ’ নীতি, কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, নোটিশ বাণিজ্যকে দায়ী করছেন।

দুদক সূত্র জানায়, হাসিনার শাসনামলে বিদ্যুৎ খাত ছিলো সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রকাশিত দুর্নীতির শ্বেতপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতে অন্তত ৬শ’ কোটি মার্কিন ডলার লোপাট হয়েছে। এর মধ্যে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে কমিশন বাবদ লুট হয়েছে ৩শ’ কোটি ডলার। কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই শুধু মাত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া ও অতিরিক্ত মুনাফা বাবদ বেসরকারি খাতেই অতিরিক্ত লুট হয় আরো ৩শ’ কোটি ডলার।

স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রকল্প পাস, সরকারি ভূমি অধিগ্রহণ এবং ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে ঋণ গ্রহণ এবং তা আত্মসাতের অভিযোগ ছিলো বিদ্যুৎ সেক্টরের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট তথ্য এবং দলিলাদি প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গতবছর ডিসেম্বরে একটি অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সংস্থার উপ-পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি টিম অনুসন্ধান শুরু করে। এ প্রক্রিয়ায় গত মে মাসে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন চুক্তির রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। চাহিত রেকর্ডপত্রের মধ্যে রয়েছে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত ২৩ হাজার ৫৮৪ মেগওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৫৬ বিদ্যুৎ কেন্দ্রর পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট ইমপ্লিমেন্টেশন (পিপিএ), চুক্তি সম্পাদন সংক্রান্ত বোর্ডের অনুমোদন, চুক্তির শর্তাবলী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অনুকূলে পরিশোধিত বিল ও বকেয়া বিল সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র। এসব তথ্য-উপাত্ত চাওয়ার মধ্য দিয়ে মূলতঃ ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা, অনুগত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতি উদঘাটনের চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।

বিদ্যুৎ সেক্টরে প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতি অনুসন্ধানের পাশাপাশি একই সময় শুরু হয় নসরুল হামিদ বিপুর সম্পদ অনুসন্ধান। দ্বিতীয়োক্ত অনুসন্ধানটির ভিত্তিতে গত বছর ২৬ ডিসেম্বর (দুদক পুনর্গঠনের ১৫ দিনের মাথায়) বিপুর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয় দুদক। তার স্ত্রী সীমা হামিদ, পুত্র জারিফ হামিদের বিরুদ্ধেও দায়ের করা হয় পৃথক মামলা। বিপুর বিরুদ্ধে মামলায় ৩৬ কোটি ৩৬ লাখ ৯৭ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়া তার ৯৮টি অ্যাকাউন্টে ৩ হাজার ১৮১ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য উল্লেখ করা হয় এজাহারে। বলাই বাহুল্য, বিদ্যুৎখাতে মোট লুট হওয়া অর্থের তুলনায় বিপু পরিবারের বিরুদ্ধে করা মামলায় উল্লেখিত ৩৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা হাস্যকর অঙ্ক মাত্র। অন্যদিকে একই সঙ্গে শুরু হওয়া বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতির অনুসন্ধান এখন অবধি মামলা পর্যন্ত গড়ায়নি। কবে এটির অনুসন্ধান শেষ হবে? কবে দায়ের হবে মামলা? কবে তদন্ত এবং চার্জশিট হবে? দুর্নীতির বিচারই বা হবে কবেÑ সংস্থাটির কেউ সেটি বলতে পারছেন না। অর্থাৎ বিপুর বিপুল দুর্নীতির বিষয়ে ‘অ্যাডহক’ ভিত্তিক সমাধান খুঁজে নিয়েছে দুদক।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি ২০২২ সালে অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাতের একটি তালিকা প্রকাশ করে। তাতে দুর্নীতিতে প্রথম থেকে সপ্তম স্থানে ছিলো যথাক্রমে ঃ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী, বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদফতর, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), বিচার বিভাগ, সরকারি স্বাস্থ্য সেবা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও ভূমি সেবা খাত। হাসিনা রেজিমের শেষ বছরগুলোতে এসব খাতে দুর্নীতি তুঙ্গীয় রূপ লাভ করে। ঘুষের বিনিময়ে ‘সেবা’ বিক্রির মাধ্যমে এসব খাতে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হয়তো কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে হাসিনার শাসনামলে এসব খাতে গৃহীত প্রকল্পগুলোতে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে প্রকল্পের নামে। দুদক কিছু কিছু প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছে। এ লক্ষ্যে টিম গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবৈধ সম্পদেরও অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধান শেষে মামলা হচ্ছে। অথচ অনুসন্ধান শেষ হচ্ছে না প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতির। ব্যক্তিগত দুর্নীতির অনুসন্ধানে সংস্থাটির কর্মকর্তারা যতটা আগ্রহ বোধ করছেন, ততোটাই অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন প্রকল্পের দুর্নীতি অনুসন্ধানে। গতবছর দুদক পুনর্গঠনের পর বিদ্যুৎ খাত ছাড়াও শেখ হাসিনা সরকার আমলে সম্পাদিত গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগের প্রকল্প, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকল্প, পানি উন্নয়ন বোর্ড, আবহাওয়া, বন ও পরিবেশ বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প, ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অন্ততঃ ১৮টি বৃহৎ প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। কিন্তু অনুসন্ধান প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে-এমন প্রকল্প সংখ্যা হাতে গোনা।

যদিও দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটির দাবি, গত এক বছরে ৩শ’ ৯৯টি মামলা করেছে। এসব মামলায় শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য,সাবেক মন্ত্রী,এমপি, শীর্ষ কর্মকর্তাসহ এক হাজারের বেশি প্রভাবশালী ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

ক্ষমতার অপব্যবহার, বড় বড় প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি করে অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ নেয়া ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলের অভিযোগ রয়েছে। আসামিদের কেউ কেউ টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন ও কানাডায় একাধিক বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। শেয়ার মার্কেট লুণ্ঠন, প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের হাজার কোটি টাকা লোপাট, অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে অনেক আসামির বিরুদ্ধে।

প্রকল্পের দুর্নীতি অনুসন্ধান করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যক্তির সম্পদে হাত দিচ্ছেন। অভিযোগ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয়,স্বজনদের রেকর্ডপত্র ধরে টানাটানিতে তারা ব্যস্ত। একজনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অনুসন্ধানে রেকর্ডপত্র চাওয়া হচ্ছে অন্ততঃ ২০ জনের। এর মধ্য থেকে হয়তো অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, তার স্ত্রী-সন্তানসহ তিন জনের বিরুদ্ধে ‘অবৈধ সম্পদ’র মামলা হচ্ছে। অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে বাকি ১৭ জনকেই। এভাবে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। নোটিশ পাঠিয়ে, তলব করে, জিজ্ঞাসাবাদ করে, নানা ধরনের রেকর্ডপত্র চেয়ে রাখা হচ্ছে ‘দৌড়ের ওপর’। এক পর্যায়ে বিশেষ বোঝাপড়ার মাধ্যমে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে তাদের। এমন অভিযোগ অনুসন্ধান-তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হরহামেশাই উঠছে। অবশ্য এ ধরনের অভিযোগে কমিশন সম্প্রতি একজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কয়েক জনের বিরুদ্ধে। অভ্যন্তরীণ তদন্তের আওতায় রয়েছেন অন্ততঃ ৬ কর্মকর্তা। শোকজ করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও বন্ধ হয়নি অনুসন্ধানের নামে ‘নোটিশ বাণিজ্য’।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মো: মঈদুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতির সঙ্গে লাঘব বোয়ালরা জড়িত থাকেন। তারা যাতে ধরা না পড়েন-প্রকল্প ভিত্তিক দুর্নীতির অনুসন্ধান বিধিবদ্ধ সময়সীমার মধ্যে শেষ না হওয়ার এটি একটি কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতির অনুসন্ধান যদি শ্লথ গতিতে চলে তাহলে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হবে। এতে ‘কম ঝুঁকি- বেশি লাভ’ এমন বার্তা যাবে দুর্নীতিবাজদের কাছে। ‘অধিক ক্ষতি-অল্প লাভ’-এমন বার্তা যাওয়া উচিৎ। অনুসন্ধানে বিলম্ব হওয়ায় দুদক এমন বার্তা দিতে পারছে না। যথাসময়ে অনুসন্ধান শেষ করে মামলা দিতে হবে। আসামি গ্রেফতার করতে হবে। আইনানুগভাবে দুর্নীতিতে ভীতি সঞ্চার করা না গেলে দুর্নীতি দমন হবে না।

দুদকের এই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, অন্য মামলায় গ্রেফতার ব্যক্তিকে ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ করার মধ্যে দুদকের কৃতিত্ব নেই। এর মধ্য দিয়ে মরাকেই মারা হচ্ছে। দুদকের নিজস্ব মামলায় সরাসরি গ্রেফতার করতে হবে। জেলায় জেলায় ‘গণশুনানি’র সমালোচনা করে মঈদুল ইসলাম বলেন, এসব তাবলীগমার্কা কার্যক্রমে দুর্নীতি দূর হবে না। এসব আইওয়াশ।

এদিকে দুদকের সাবেক প্রসিকিউটর, সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, দুদক হিম সেলফ অ্যা করাপ্ট ইনস্টিটিউট। বর্তমান কমিশন দুদক সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভাঙতে পারেননি। বরং পূর্বতন ধারণার উত্তরাধিকার বহন করছে। হাসিনা রেজিমে বিভিন্ন সরকারি দফতরে প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। লোপাটকৃত অর্থ পাচার হয়েছে। প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতির কয়টি মামলা হয়েছে বলুন? কয়জন দুর্নীতিবাজকে দুদক নিজে সরাসরি গ্রেফতার করতে পেরেছে? অ্যাসেটের মামলাতো সর্বশেষ অস্ত্র। কিন্তু কমিশন শেষ অস্ত্রটি ব্যবহার করে ফেলছে প্রথমেই। এসব কারণে আমরা এ কমিশনের প্রতি খুব একটা আশাবাদী হতে পারি নাÑ যোগ করেন এ আইনজীবী।

এদিকে প্রকল্পের চেয়ে ব্যক্তির সম্পদ অনুসন্ধানে অধিক আগ্রহ সম্পর্কে দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো: আকতার হোসেন বলেন, আমরা সব ধরনের দুর্নীতির অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছি। প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতির অভিযোগগুলোর অনুসন্ধান কোন্ পর্যায়ে রয়েছে-এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান টিমগুলোর সঙ্গে কথা বলে পরে জানানো যাবে।