Image description

গতকাল ১৫ আগস্ট শেরপুরে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন মনোয়ারা বেগম। অটোরিকশার চাকা ও মোটরে ওড়না পেঁচিয়ে মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাঁর মাথা। ঘটনাস্থলেই নিভে যায় একটি জীবন। অথচ এর আগেও ১১ মার্চ একই জেলার মিম আক্তার নামের ষষ্ঠ শ্রেণির এক স্কুলছাত্রী চলন্ত অটোরিকশার চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে প্রাণ হারিয়েছিল।

যশোরের মেধাবী এইচএসসি পরীক্ষার্থী সুমাইয়া ছায়ার ঘটনাটি আজও মানুষ ভুলতে পারেনি। চলন্ত রিকশায় বসে বৃষ্টির পানি ঠেকাতে সামান্য ঝুঁকেছিলেন তিনি। ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লেগে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। টানা ১২ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে ৭ আগস্ট না ফেরার দেশে চলে গেলেন সুমাইয়া।

একই মাসের ১২ তারিখ মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মোটরসাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে প্রাণ হারান স্কুলশিক্ষিকা হোছনা বেগম।

এর আগে ৫ মে রাজধানীর আফতাবনগরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে কলেজছাত্রী আজরাত সাদিয়ার মৃত্যু হয়। তার পরের দিনই ময়মনসিংহের ভালুকায় একইভাবে প্রাণ হারান দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রুবায়েত আফরোজ সেজুতি।

১২ জুলাই মাদারীপুরে ইজিবাইকে ওড়না পেঁচিয়ে আয়শা আক্তার নামের এক শিক্ষার্থী মারা যান।

একই মাসের ২৩ তারিখ যশোরে চলন্ত ভ্যানে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে নিভে যায় গৃহবধূ মনিরা খাতুনের জীবন। জুনের ১২ তারিখ পটুয়াখালীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় মারা যান এইচএসসি পরীক্ষার্থী অধরা চৌধুরী মোহনা। ২২ জুন বাবার মোটরসাইকেলে চড়ে কলেজে যাওয়ার পথে চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে প্রাণ হারান ইশরাত জাহান শান্তা। একই মাসের ৩০ তারিখ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রিকশার চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মোছা. মিথিলা আক্তার।

এই তালিকা শেষ হয় না।

৬ এপ্রিল রাজধানীর গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরে রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলে ওড়না পেঁচিয়ে মারা যান ফারজানা আক্তার মিম। ৯ এপ্রিল নওগাঁর রাণীনগরে ভ্যানের চাকায় শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে প্রাণ হারান বুলবুলি বিবি। ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় রিকশার চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নিহত হন এসএসসি পরীক্ষার্থী রাদিয়া ইসলাম প্রিয়া। মাত্র পাঁচ দিন পর, ১৩ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জে একইভাবে প্রাণ হারান জয়তুন বিবি। ২২ ফেব্রুয়ারি নীলফামারী সৈয়দপুরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ওড়না পেঁচিয়ে মারা যান রোকসানা আক্তার।

 

স্কুলছাত্রী, কলেজছাত্রী, পরীক্ষার্থী, গৃহবধূ কিংবা শিক্ষকতা করা নারী—তালিকা শুধু বড় হচ্ছে। প্রতিমাসেই কোথাও না কোথাও অটোরিকশা, ইজিবাইক বা মোটরসাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নিভে যাচ্ছে একটি জীবন। মুহূর্তেই থেমে যাচ্ছে একেকটি স্বপ্ন।

ইশরাত জাহান শান্তা তো কেবল বাবার মোটরসাইকেলে চেপে কলেজে যাচ্ছিলেন। সুমাইয়া ছায়া ঝুঁকেছিলেন রিকশার সামনের পলিথিন ঠিক করতে। রাদিয়া ইসলাম প্রিয়া ফিরছিলেন কোচিং ক্লাস শেষে। অধরা চৌধুরী মোহনা যাচ্ছিলেন বন্ধুর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে। কে জানত, এমন সাধারণ মুহূর্তেই চিরতরে শেষ হয়ে যাবে সব?

অথচ সামান্য সচেতনতা হয়তো বাঁচাতে পারত মিম, বুলবুলি, জয়তুন কিংবা রোকসানাদের জীবন। প্রতিবার দুর্ঘটনার পর সমাজ শোকাহত হয়, আলোচনার ঝড় ওঠে, কিন্তু তারপর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কেন বারবার এমন হচ্ছে? কেন চাকায় পেঁচাচ্ছে ওড়না? প্রশ্নটা আমাদের সবার ভেবে দেখা দরকার।

এখন সময় এসেছে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ—সবাইকে একসঙ্গে সচেতন হওয়ার। রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক কিংবা মোটরসাইকেলে ওঠার সময় কাপড়, বিশেষ করে ওড়না, আঁচল বা শাড়ি যেন চাকায় না পড়ে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। চালকদেরও সচেতন হতে হবে, গাড়ির পাশে বসা যাত্রীদের কাপড় ঝুলে থাকলে সতর্ক করতে হবে। একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষ চাইলে যানবাহনের চাকায় প্রটেকশন কাভার বাধ্যতামূলক করতে পারে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে নিয়মিত প্রচারণা চালাতে হবে, গণমাধ্যমে প্রচার বাড়াতে হবে।

প্রতিটি অকাল মৃত্যুর পেছনে লুকিয়ে থাকে অসচেতনতা আর অবহেলা। অথচ একটু সতর্ক হলেই হয়তো অটোরিকশার চাকার ফাঁদে হারাতে হতো না এতগুলো তরতাজা প্রাণ।