Image description
চীনে বাংলাদেশিদের চিকিৎসায় অভিজ্ঞতা ইতিবাচক, রয়েছে কিছু অসুবিধাও

দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের সবচেয়ে স্বস্তির গন্তব্য ছিল ভারত। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের পর প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে পুরনো সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়, যার প্রভাবে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে দেশটি। এমন পরিস্থিতিতে চীনের কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতালকে বাংলাদেশিদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে সে দেশের সরকার। সেখানে চিকিৎসা সুবিধা দেখতে গত ১০ মার্চ বাংলাদেশি রোগীদের প্রথম দল কুনমিং যায়। ওই দলের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন চিকিৎসক, ট্র্যাভেল এজেন্ট, সাংবাদিকরাও।

কুনমিং ঘুরে আসা বাংলাদেশের রোগী, চিকিৎসক, পর্যটন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা চীনের চিকিৎসা নিয়ে ইতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ভাষা, বাড়তি ভিসা ফি, ব্যাংকে কমপক্ষে ১০ হাজার ডলার থাকার বাধ্যবাধকতা এবং বিমান ভাড়াসহ কিছু বিষয়কে বাধা হিসেবে দেখছেন তাঁরা। মার্চ মাসে বাংলাদেশ থেকে কুনমিং যাওয়া প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ছিলেন সংগীতশিল্পী হায়দার হোসেন।

হৃদরোগ ছাড়াও ঘাড়ের ব্যথায় ভুগছেন তিনি। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে হায়দার হোসেন বলেন, আমি হার্টের চিকিৎসা করিয়েছি। ঢাকায় আমাকে তিন-চার লাখ টাকা খরচ করতে হতো। সেখানে চিকিৎসা, থাকা-খাওয়াসহ খরচ হয়েছে এক হাজার ডলারের মতো।
এই খরচটা বিমান ভাড়া বাদে। বড় বিষয় হলো তাদের চিকিৎসাব্যবস্থা, রোগী ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো, ঢাকায় যেটা হয় না।
প্রস্ট্রেটে সমস্যার চিকিৎসা করাতে সম্প্রতি চীন ঘুরে এসেছেন আজিজুল হাকিম। তিনি বলেছেন, আমাকে থরো ইনভেস্টিগেশন করেছে। ১১০০ ইউয়ান অর্থাৎ প্রায় ১৭ হাজার টাকা নিল, থাইল্যান্ডে হলে তিন লাখ টাকার মতো লাগত।
আমার কোনো অস্ত্রোপচার লাগেনি, চিকিৎসকরা বলেছেন, আপাতত ওষুধ খেলেই হবে। তবে কুনমিংয়ের বিমান ভাড়া অনেক বেশি। এটা কমাতে না পারলে রোগীরা সেখানে গিয়ে সুবিধা করতে পারবে না।

প্রধান অন্তরায় বিমান ভাড়া : চীনে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পথে যেসব বিষয় অন্তরায় হতে পারে তা ইতিমধ্যে চিহ্নিত করেছেন মেডিক্যাল ট্যুরিজম কম্পানি ট্র্যাক মেডি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী রাশেদুল হাসান বলেন, যাঁরা চীনে গেছেন, তাঁদের অনেকেই ভাষাগত সমস্যার কারণে অ্যারাইভাল কার্ড ফিলাপ করতে পারেননি। মেডিক্যাল ভিসায় আবেদনের সময় রোগী বা অ্যাটেনডেন্টের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কমপক্ষে ১০ হাজার ডলার জমা থাকতে হবে। অথচ ভারতীয় ভিসা আবেদনে ২০০ ডলার, থাইল্যান্ডের জন্য দেড় লাখ টাকা থাকলেই হয়। এ ছাড়া ঢাকা থেকে কুনমিংয়ের বিমান ভাড়া ৪০ হাজার টাকার বেশি।

চীনের ভিসা ফি থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ভারতের ভিসা ফির কাছাকাছি আনা একটা বড় বাধা। রোগী এবং অ্যাটেনডেন্টের ভিসা তিন-চার দিনের মধ্যে ইস্যু করা।  চীনের বিমানবন্দরে যাওয়ার পর ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করা। বিমানবন্দরে রোগী এবং স্বজনদের সহায়তার জন্য বাংলাভাষী সহায়তাকারী রাখা। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে যাত্রীদের পিক-আপের ব্যবস্থা করা। দীর্ঘ সময় চীনে অবস্থানের জন্য সাশ্রয়ী আবাসনের ব্যবস্থা। বিভিন্ন বয়স-রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় আলাদা আলাদা হেলথ প্যাকেজের ব্যবস্থা রাখা। মেডিক্যাল রিপোর্ট চীনা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে দেওয়া। চীনে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার আগে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকের সঙ্গে ভিডিও কনসালটিংয়ের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনীয় সুবিধাসম্পন্ন এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা রাখা। কোনো রোগী চীনে মারা গেলে মরদেহ দেশে ফেরানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা। বিমানবন্দরে রোগীদের জন্য মোবাইল সিম কার্ডের ব্যবস্থা রাখা। চীনের হাসপাতালগুলো যেন রোগীদের আন্তর্জাতিক হেলথ ইনস্যুরেন্স গ্রহণ করে, সেই ব্যবস্থা করা।

বিদেশনির্ভর চিকিৎসায় শীর্ষ দশে বাংলাদেশ : চিকিৎসার জন্য বিশ্বের যেসব দেশের মানুষ বিদেশে বেশি যায় সেই তালিকার দশম স্থানে বাংলাদেশ। বাংলাদেশি রোগীদের ৫১ শতাংশ যেত ভারতে। থাইল্যান্ডে যায় ২০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ২০ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে রোগী যাওয়ার হার ৩ শতাংশ। ২ শতাংশ করে যায় জাপান ও মালয়েশিয়ায়। ১ শতাংশ করে যায় চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী রোগীদের ৫৩ শতাংশ বিদেশ যায় মূলত রোগনির্ণয় বা চেকআপের জন্য। তবে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের সবচেয়ে বেশি মানুষ যায় হৃদযন্ত্রসংশ্লিষ্ট অস্ত্রোপচার, চোখের ছানিজনিত অস্ত্রোপচার, কিডনি রোগ ও ক্যান্সারজনিত সমস্যা নিয়ে।

বাংলাদেশ থেকে চীনে চিকিৎসার জন্য কেউ যায় কি না কিংবা বছরে কতজন যায়, তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে চীনের দূতাবাসও এ বিষয়ে তথ্য দিতে পারেনি। তবে বেল্ট অ্যান্ড রোড হেলথকেয়ার সেন্টার, বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী মারুফ মোল্লা কালের কণ্ঠকে জানান, গত ডিসেম্বরের পর থেকে প্রতি মাসে ৫০ জনের বেশি রোগী চীনে যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য। সবচেয়ে বেশি যায়, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামের রোগীরা। তিনি বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের রোগীদের বিদেশে পাঠানো নয়। দেশের হাসপাতালগুলোতে চীনের উন্নত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা। যাতে দেশের সব মানুষ চীনের উন্নত সেবা পায়। এ জন্য এরই মধ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে চীনের এমওইউ হয়েছে। এর মাধ্যমে চীন থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে।

চীনের তিনটি সরকারি এবং একটি বেসরকারি হাসপাতাল বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলো হচ্ছে, দ্য ফার্স্ট পিপলস হসপিটাল অব ইউনান প্রভিন্স, দ্য ফার্স্ট অ্যাফিলিয়েটেড হসপিটাল অব কুনমিং মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি, চায়নিজ একাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্সেসের ফাওয়াই ইউনান হসপিটাল এবং ট্র্যাডিশনাল চায়নিজ মেডিক্যাল হসপিটাল (টিএমসি)।

মেডিক্যাল ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান সিওক হেলথকেয়ারের প্রধান নির্বাহী এম এম মাসুমুজ্জামান বলছেন, চীনে দুই ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি ব্যবহৃত হয়; আধুনিক এবং চীনের প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি। তারা মডার্ন মেডিসিন এবং ট্র্যাডিশনাল চায়নিজ মেডিসিনের কম্বিনেশন করে চিকিৎসা দেয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য চীনে যাওয়া রোগীর সংখ্যা কম। ব্যবসার কাজে, বেড়াতে বা পড়াশোনা করতে যারা চীনে গেছে, তাদের স্বজনদের অনেকে চীনে চিকিৎসা নেন। তবে সেই সংখ্যা খুবই কম। ভারতের ভিসা কড়াকড়ির পর চীনের কথা ভাবতে শুরু করেছে অনেকে।