
বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের পাঁচ দশকের কূটনৈতিক সম্পর্ক বরাবরই চড়াই - উতরাইয়ের । এর মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে এ সম্পর্ক টিকে ছিল সুতোর ওপর । গণ - অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি ভারতে আশ্রয় নিলে দেশটির চিরবৈরী পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে গতি আনতে সক্রিয় হয় । এর অংশ হিসেবে পাকিস্তানের দুজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আগামী সপ্তাহের শেষ দিকে ঢাকা সফরের কথা রয়েছে । এরপর শিগগিরই আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী আসতে চান , এমনটা জানিয়ে রেখেছে দেশটি । তবে পাকিস্তান দ্রুত সম্পর্ক জোরদার করতে চাইলেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার একটু রয়েসয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে চাইছে ।
সরকারের ভেতর- বাইরের বিশ্লেষকেরা বলছেন , বাংলাদেশকে নিজস্ব সীমান্ত , দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , বাণিজ্যিক ও কৌশলগত বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই চলতে হচ্ছে । পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো . তৌহিদ হোসেন বলেছেন , ‘ বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক চায় । এ সম্পর্ক অস্বাভাবিকভাবে উচ্চতর স্তরে যাবে না । ' তবে তিনি বলেন , শেখ হাসিনার সময় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না । সেই অবস্থান থেকে সরকার বের হয়ে এসেছে । সম্পর্কে গতি আনতে গত এপ্রিলে ঢাকা ঘুরে গেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ । এরপর জুলাইয়ে এশিয়া ক্রিকেট কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে ঢাকায় এলেও একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক ঝালাইয়ে তৎপর ছিলেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন রাজা নাকভি । এবার ২১ আগস্ট চার দিনের জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের ঢাকায় আসার কথা রয়েছে । এর দুই দিনের মধ্যে ২৩ আগস্ট আসবেন উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ।
ইসহাক দার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো . তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ও জাম কামাল বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন । তাঁদের আলাদাভাবে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা রয়েছে । সরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী , ইসহাক দারের সফরে অনেকগুলো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করতে চায় পাকিস্তান । শেষ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক সহযোগিতা , কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য পারস্পরিক ভিসা বিলোপসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিন - চারটি দ্বিপক্ষীয় দলিল সই হতে পারে । এই আগস্টেই দুই দেশের যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের ( জেইসি ) বৈঠকে পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিতে ঢাকায় আসার কথা ছিল অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ আওরঙ্গজেবের । বাংলাদেশ প্রস্তুত না থাকায় এ সফরটি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে । পাকিস্তানের দিক থেকে আসা বিকল্প প্রস্তাবে সায় দিয়ে আগামী সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবরে এ বৈঠকটি হতে পারে । সর্বশেষ এ বৈঠকটি হয়েছিল ২০০৫ সালে ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন , পাকিস্তানের দুজন ঊর্ধ্বতন মন্ত্রীর একই সময়ে একই রাজধানীতে অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ । যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে গতি আনতে পাকিস্তানের এমন তৎপরতা নতুন নয় । ঢাকার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখাকে ইসলামাবাদের সকল মহল সব সময়ই একটি ভালো সুযোগ হিসেবে দেখে থাকে । একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সংস্থা ওআইসির সদস্য হয় । এই সংস্থার প্রভাবশালী সদস্যরাষ্ট্র সৌদি আরব , মিসর , লিবিয়া , আলজেরিয়া , ইরান ও তুরস্কের মাধ্যমে পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপনের জন্য জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালায় । দেশটি ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের সূচনা করে । তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তানের লাহোরে নামার ঠিক আগে আগে এ স্বীকৃতি আসে । এর চার মাসের মধ্যেই শেখ মুজিবের আমন্ত্রণে জুনে ঢাকা সফর করেন পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো । এরপর থেকে ভালো - মন্দের মিশেলে সম্পর্ক এগিয়ে চলে তিন দশকের বেশি সময় ।
অবশ্য ২০০৯ সাল থেকে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে । কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন , বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্যের বিকল্প উৎস হতে পারে পাকিস্তান । এমনটা আগেও ছিল । ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের অনেকে মনে করেন , পাকিস্তান বাংলাদেশে তুলা , কাপড় , সামরিক সরঞ্জাম , চিনি ও রাসায়নিক সামগ্রী রপ্তানি বাড়াতে চাইবে । এর বাইরে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতেও দেশটি থেকে বাংলাদেশ বিভিন্ন সুবিধা নিতে পারবে ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি ডলারের মতো । দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের চিরবৈরী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ১৬ বছর ‘ সোনালি অধ্যায় ’ থাকলেও শেখ হাসিনার অবর্তমানে এ সম্পর্ক বছরখানেক প্রায় নিশ্চল অবস্থা চলছে । এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্পর্কে গতি আনার জন্য কী কী করে , তার ওপর ভারত ছাড়াও আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর নজর থাকবে , এমনটা মনে করছেন বিশ্লেষকেরা । গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির আজকের পত্রিকাকে গতকাল শুক্রবার বলেন , সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারতের বিরুদ্ধে যাতে ব্যবহার করতে না পারে । ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ স্থল ও সমুদ্র সীমানা থাকা , অর্থনৈতিক স্বার্থ ও নিরাপত্তা ঝুঁকিগুলোর উল্লেখ করে পাকিস্তানকে সরাসরি বলতে হবে , বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না — এ নিশ্চয়তা পাকিস্তান সরকারকে দিতে হবে । যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন , ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন যেসব দায়দেনা বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের আছে , সেই প্রসঙ্গগুলোও সরকারকে জোরালোভাবে তুলতে হবে । পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন , ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় থাকবে ।