Image description
 

আজম-তমা-ম্যাক্স এই দুর্নীতির ত্রিচক্র বাংলাদেশে সরকারি ঠিকাদারিতে একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করেছিল গত সাড়ে ১৫ বছর। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাথমিক হিসাবে, এই দুর্নীতিবাজ তিন চক্র মিলে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট করেছেন।

 
 
এই লুটের একটি বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশন মনে করছে। উল্লেখ্য যে, তমার কর্ণধার আতাউর রহমান ভুঁইয়া মানিক এখন পলাতক। ম্যাক্সের কর্ণধার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় গ্রেপ্তার করেছে দুদক। মির্জা আজম পালিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। এই তিনজনের দেশের সম্পত্তি এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হলেও বিদেশের সম্পদের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সিআইডির যৌথ অনুসন্ধানে এই তিনজনের বিরুদ্ধেই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

 

সিআইডির একটি সূত্র বলছে, এই তিন ব্যক্তি অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন। তমা প্রপার্টিজের নামে বিশ্বের চারটি দেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। আতাউর রহমান ভুঁইয়া মানিক দুবাইতে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন এবং একটি শপিং মলে তার একাধিক দোকানের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া দুবাইতে মানিকের নামে একটি পেট্রোল পাম্পের সন্ধানও পাওয়া গেছে। দুবাই ছাড়াও মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম স্কিমে আতাউর রহমান ভুঁইয়া মানিক তার সপরিবারে সদস্যপদ গ্রহণ করেছেন। মালয়েশিয়াতে মানিকের বিনিয়োগ রয়েছে। সিঙ্গাপুরে তমা কনস্ট্রাকশনসের নামে একটি কোম্পানি নিবন্ধন করা হয়েছে। সেই নিবন্ধিত কোম্পানিটির মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছে তমা কনস্ট্রাকশনসের কর্ণধার। এ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তার সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার সম্পদের ক্ষেত্রে মির্জা আজমের এক নিকট আত্মীয় তাকে সহযোগিতা করছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে। ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের কর্ণধার আলমগীরের বিরুদ্ধেও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি সূত্র বলছে যে, আলমগীর বিদেশে কী পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন সে ব্যাপারে এখনো তদন্ত চলছে। সিআইডির প্রাথমিক তদন্তে ম্যাক্স গ্রুপের কর্ণধার আলমগীরের বিরুদ্ধে অন্তত তিনটি দেশে অর্থ পাচারের প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডে। সিআইডির একটি সূত্র বলছে, তারা ধারণা করছে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং দুবাইতেও তাদের পাচারকৃত অর্থ রয়েছে। তবে এ সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য কাজ করছে দুদক এবং সিআইডির যৌথ টিম। দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, তমা এবং ম্যাক্স গ্রুপ যে পরিমাণ অর্থ লুণ্ঠন করেছেন তার অবৈধ পরিমাণ সম্পদ এ দেশে নেই। অধিকাংশ সম্পত্তি তারা বিদেশে পাচার করেছেন। অনুসন্ধানে গত সাড়ে ১৫ বছরে তমা এবং ম্যাক্স বাংলাদেশে যে পরিমাণ কাজ করেছে, সেখানে তাদের নিট মুনাফা অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা। সেখানে সারা দেশে তমা-ম্যাক্সের সম্পদের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি নয়। প্রশ্ন উঠেছে, বাকি টাকা কোথায়? দুর্নীতি দমন কমিশন মনে করছে, এই টাকা তারা বিদেশে পাচার করে থাকতে পারে। এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে তমা এবং ম্যাক্সের লাঠিয়াল এবং রাজনৈতিক পার্টনার হিসেবে পরিচিত মির্জা আজমও তাদের মতো সুকৌশলে বিদেশে টাকা পাচার করেন বা টাকা পাচারের ক্ষেত্রে কোনো গোপনীয়তাও অনুসরণ করেননি। বরং দেশে-বিদেশে তিনি বানিয়েছেন সম্পদের পাহাড়। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাথমিক হিসাবে দেখা গেছে, মির্জা আজম দেশে প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিদেশিও তার সম্পদের পরিমাণ হাজার কোটি টাকার বেশি। ঢাকার ধানমন্ডি ১৫ নম্বর রোডে (পুরাতন ২৮ নম্বর) ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রভাব খাটিয়ে সরকারি প্লট দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন মির্জা আজম। তিনি পরিবারপরিজন নিয়ে বাস করতেন একই রোডের ১২ নম্বর বাড়িতে। ১৯৯৬ সালে এমপি থাকাকালে ঢাকার নিকুঞ্জ ২ নম্বর আবাসিক এলাকায় ৫ কাঠার প্লট রাজউক থেকে কিনে নিয়েছিলেন তিনি। এরপর ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর প্রভাব খাটিয়ে প্লট পরিবর্তন করে বারিধারায় ১০ নম্বর সড়কে নতুন প্লট নিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেন। ঢাকা ছাড়াও জামালপুর শহরে পৌরসভা ভবনের পাশে আছে মির্জা আজমের স্ত্রী আলেয়া আজমের নামে বিলাসবহুল বাড়ি আলেয়া কটেজ। গত ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা তাতে ভাঙচুর চালায়। জামালপুর পৌরসভা এলাকার সুরপাড়া দেউরপাড় চন্দ্রায় ১০ একর জমিতে আলেয়া গার্ডেন নামে একটি রিসোর্ট রয়েছে। মেলান্দহ উপজেলার দুরমুট ইউনিয়নে তমা কংক্রিট লিমিটেডে তাঁর বড় অঙ্কের শেয়ার রয়েছে। মেলান্দহর নয়ানগর ইউনিয়নের কান্দাপাড়ার বাসিন্দা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা (বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক) মিনহাজের নামে জামালপুর শহরে এবং শহরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৩০০ একর জমি কিনেছেন তিনি। জামালপুর শহরের বকুলতলা মোড়ে ৮ শতাংশ জমির ওপর তাঁর বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। জেলা শহরের মেডিকেল রোডে তিন তলা দুটি বাড়ি আছে। জেলা শহরের বজ্রাপুর এলাকায় মির্জা রাইস মিলটি পরিচালনা করেন তাঁর ভাই মির্জা কবির। মাদারগঞ্জ উপজেলা পৌর শহরের বালিজুড়ি বাজারে দুই একর জমিতে নুরুন্নাহার মার্কেট ও বকুল মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মাদারগঞ্জ উপজেলা চত্বরে এক একর জমিতে দুটি মার্কেট, উপজেলাসংলগ্ন ২ একর জমি, মেলান্দহ উপজেলার পৌর শহরের বকুলতলার পাশে ৩০ শতাংশ জমি (কোয়েলী সিনেমা হলের জমি) রয়েছে। ময়মনসিংহের ভালুকা ডেইরি ফার্ম নামক প্রতিষ্ঠানে শেয়ার রয়েছে মির্জা আজমের। মাদারগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তাঁর নামে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি রয়েছে। শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে নালিতাবাড়ী ফিশারিজের মালিক মির্জা আজমের স্ত্রী আলেয়া আজম। কক্সবাজারে পাঁচ তলা সিগাল হোটেলের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার তিনি। এই হোটেলের চেয়ারম্যান মির্জা আজমের স্ত্রী। এ ছাড়া নেত্রকোনায় শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রীর নামে বিপুল সম্পদ করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া মির্জা আজমের হলফনামায় মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছিল ৬৫ কোটি ৭১ লাখ ৩০ হাজার, যা বর্তমানে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তার আলাদিনের চেরাগের অন্যতম দৈত্য হলো দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা এবং ম্যাক্স। সবাই মনে করত তমা গ্রুপের তিনি অন্যতম অংশীদার। কিন্তু বাস্তবে তমা কনস্ট্রাকশনে তার কোনো শেয়ার নেই। তিনি সেখানে দালালি করে এবং কমিশন বাণিজ্য করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তমা এবং ম্যাক্সকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন। শেখ হাসিনার সরকারের ১৫ বছর কনস্ট্রাকশন সেকশনে তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের অন্যতম সহায়তাকারী ছিলেন। এ ছাড়াও নিজের নামে অপি হাউজিং কোম্পানির নামে একটি কোম্পানি খুলেছিলেন। মার্কিন প্রবাসী আবু সালেহ গেন্দা নামে একজন তার নিকট আত্মীয়, তার অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন বলে জানা গেছে। আজমের বিদেশের সম্পদের দেখাশোনা তিনিই করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে মির্জা আজমের অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে তথ্য এসেছে। মির্জা আজমের বিদেশেও বিপুল পরিমাণ সম্পদের প্রাথমিক সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেন্দার নামে দুটি পেট্রোল পাম্প, চারটি বাড়ি রয়েছে যেটি মির্জা আজমের টাকা দিয়ে করা বলে অনেকে ধারণা করছেন। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরে মির্জা আজমের বাড়ি রয়েছে। মির্জা আজম, তার স্ত্রী এবং দুই কন্যা প্রত্যেকেই মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের মাধ্যমে দেশটির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সিআইডি বলছে তাদের যে সম্পদ রয়েছে সে সম্পদের ব্যাপারে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করছে। বাস্তবে তাদের সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই সিআইডি বিভিন্ন দেশে তমা, ম্যাক্স এবং মির্জা আজমের সম্পদ তথ্য হালনাগাদ পাবে বলে আশা করছে। তখন জানা যাবে বাংলাদেশে ঠিকাদারিতে এই দুর্নীতিবাজ এই ত্রিচক্র কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন।