Image description
 

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সুবিধাভোগীদের মধ্যে অন্যতম ব্যবসায়ী নাহিদুজ্জামান নিশাদ। দলটির স্থানীয় শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় অনেক হোমরা-চোমরার সঙ্গে তার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও হোটেলে।

 

আওয়ামী লীগের রাতের ভোট ও ডামি নির্বাচন সফল করতে দুবার হয়েছিলেন প্রার্থী। গত বছরের ৫ আগস্ট জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে পাল্টিয়ে ফেলেন ভোল। যোগাযোগ করেন করে অভ্যুত্থানপন্থি বড় দল বিএনপির স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে, মেলে অভাবনীয় সাফল্য। পেয়েছেন গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সহসভাপতির পদ। তিনি কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে এই পদ বাগিয়েছেন বলে অনেক নেতাকর্মী বলে বেড়াচ্ছেন।

 

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাতারাতি দল পাল্টে হয়ে গেছেন

২০২৪ সালের ডামি ভোটের প্রার্থী নিশাদের দাদা বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ী ইউনিয়নের বগার ভিটা গ্রামে। তার বাবা কাজের সুবাদে বেশ আগে বগুড়ায় পাড়ি জমান এবং সেখানেই বাড়ি বানিয়ে বসবাস শুরু করেন। সেই থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে বগুড়া শহরের সেউজগাড়ীতে থাকছেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন নিশাদ। তবে যাতায়াত আছে উভয় জেলায়। সবকিছুই বগুড়ায় হলেও নির্বাচন ও রাজনৈতিক পদ নিয়েছেন গাইবান্ধায়। গত ১৪ নভেম্বর পেয়েছেন জেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদ। তখন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, দলীয় নির্দেশে নাহিদুজ্জামান নিশাদকে গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সহসভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।

 

নিশাদ বগুড়া শহরে গড়ে তুলেছেন ‘রোচাস হোটেল’ নামের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যা আওয়ামী আমলে সরকারি কর্মকর্তা ও নেতাদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছিল। বর্তমানে সেটি বিএনপির বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা ও কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থলে রূপ নিয়েছে।

 

ফ্যাসিস্ট হাসিনার ডামি নির্বাচন সফল করার জন্য ২০২৪ সালে গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনে আপেল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে বিশেষ কারণে ভোটের আগের দিন সরে দাঁড়ান। এর আগে ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি একই আসনে স্থগিত উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তবে জনরোষের ভয়ে সেই নির্বাচনেও ভোটগ্রহণের আগে সরে দাঁড়ান।

 

বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিশাদকে ঘিরে গাইবান্ধার সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলায় বিএনপির স্থানীয় রাজনীতিতে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। অনুপ্রবেশকারী এই নেতা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার দাপটে দুই উপজেলায় গত ১৬ বছরে মামলা, হামলা, নির্যাতনের শিকার ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে টাকার প্রভাবে একটি অংশকে নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন।

 

নির্বাচনি প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সাঘাটা ও ফুলছড়ির বিএনপি নেতাদের বসে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন নিশাদ। যাকে যেভাবে বাগে আনা সম্ভব সেভাবেই চেষ্টা করছেন তিনি। যারা তার কথা শুনতে চাইছে না বা তার আনুগত্য মানছেন না তাদের তিনি নানাভাবে হয়রানি ও অপদস্থ করছেন। এমনকি দল থেকে বহিষ্কারও করার অভিযোগ আছে। এছাড়া দীর্ঘ দেড় দশক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে জেল-জুলুমের শিকার নেতাকর্মীরা তার অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন।

 

নিশাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

বগুড়া শহরে সুরম্য অট্টালিকায় থাকেন নিশাদ। মন জয়ের জন্য সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের বাসায় দাওয়াত করে খাওয়ানো তার পুরোনো কৌশল। তার হোটেল রোচাসে আড্ডা-পার্টি সবই চলে নিয়মিত। স্থানীয় জয়যুগান্তর নামে একটি পত্রিকাসহ নিটোল টাটা কোম্পানির ডিলারশিপ ও বেশকিছু ব্যবসা আছে তার। জয়পুরহাটে সাইবারটেক পলিটেকনিক অংশীদার জাহিদের কাছ থেকে জোরপূর্বক লিখে নেন এবং বগুড়ায় স্কুল অব দ্য হলি কুরআন নামে প্রতিষ্ঠান নজরুল ইসলামের কাছ থেকে কৌশলে আওয়ামী লীগ আমলে লিখে নেন।

 

বহিষ্কার হওয়ার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাইবান্ধা জেলা বিএনপির কয়েক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ‘নিশাদকে আমরা আগে গাইবান্ধার রাজনীতিতে কখনো দেখিনি। তবে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হিসেবে দুবার নির্বাচন করেছেন। এটা আমাদের জন্য বিস্মিত করেছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য কাজ করছি তাদের মূল্যায়ন না করে এক বহিরাগতকে এমন পদ দেওয়াটা দুঃখজনক। বিষয়টি তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের হতাশ করেছে।’

 

একই কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নেতা বলেন, নিশাদ বিএনপির পদ পাওয়ার পরই এক পক্ষকে কাছে নিয়ে টাকার খেলায় মেতেছেন। নেতাকর্মীদের বসে আনতে না পারলেই বহিষ্কার, কারণ দর্শানোর নোটিস, মামলা-হামলাসহ নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তৃণমূল থেকে জেলা পর্যন্ত তার থাবা থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। তার কারণে ইতোমধ্যে সাঘাটা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির মাঝে ফাটল ধরেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি দেওয়ার আলোচনা হলেই টাকার বিনিময়ে আওয়ামী ক্যাডারদের না অন্তর্ভুক্ত করছেন নিশাদ।

 

সাঘাটা উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব (সাময়িক অব্যাহতিপ্রাপ্ত) ও ঘুড়িদহ ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান সেলিম আহম্মেদ তুলিপ বলেন, ‘আমি ৩৫ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করি। আমি কোনো অপরাধে জড়িত না থাকলেও সদ্য নেতা হওয়া নিশাদের কথা না শোনায় মিথ্যা অভিযোগে আমাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’

 

জুমাড়বাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক আবু তাহের মন্ডল বলেন, বিএনপি অনুপ্রবেশকারী নিশাদ এই দলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের দোসরদের পুনর্বাসন করছেন। এর অংশ হিসেবে জাসদের গাইবান্ধা জেলা কমিটির সহসভাপতি রুস্তম আলী আকন্দকে কৃষক দলের সদস্য করেছেন।

 

গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সভাপতি ডা. মঈনুল হাসান সাদিক আমার দেশকে বলেন, বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশেই নিশাদকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ আছে, তবে সেগুলো হাইকমান্ডও জানে। আগামী নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে কি না, সেটা হাইকমান্ডই সিদ্ধান্ত নেবে।

 

আট কোটি টাকা দিয়ে বিএনপির পদ কিনে নেওয়ার বিষয়ে জানতে নিশাদের মোবাইল ফোনে কয়েক দফায় কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি ম্যাসেজ দিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।