
মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে রংপুরের তারাগঞ্জে দু’জন নিহতের ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় চলছে। সর্বত্রই আলোচনা-সমালোচনা। প্রশ্নের মুখে পড়েছে পুলিশ-প্রশাসন। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এ ঘটনায় বুধবার রাতে তারাগঞ্জ থানার দুই এসআইসহ ৮ পুলিশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এদিকে, হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ৪ আসামিকে তিনদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে এলাকা।
৮ পুলিশ সদস্য সাময়িক বরখাস্ত: দায়িত্বে অবহেলার ঘটনায় বুধবার রাতে তারাগঞ্জ থানার দুই এসআইসহ ৮ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে জেলা পুলিশ। তারা হলেন- তারাগঞ্জ থানার এসআই আবু জোবায়ের, এসআই সফিকুল ইসলাম, কনস্টেবল ফারিকুদ আখতার জামান, ধীরাজ কুমার রায়, হাসান আলী, ফিরোজ কবির, মোক্তার হোসেন ও বাবুল চন্দ্র রায়। তাদের রংপুর জেলা পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার চারজন ৩ দিনের রিমান্ডে: এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ৪ আসামির ৩ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় গ্রেপ্তার হওয়া চার আসামি তারাগঞ্জের সয়ার ইউনিয়নের চরকডাঙ্গা বালাপুর গ্রামের আলেফ উদ্দিনের ছেলে আখতারুল ইসলাম (৪৫), রহিমাপুরের আইয়ুব আলীর ছেলে মিজানুর রহমান (২৬), বুড়িরহাট ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের জাফর আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম (৪০) ও সয়ার বালাপাড়ার আজিজুল ইসলামের ছেলে ইবাদত আলীকে (৩৫) আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এ সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তারাগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রফিকুল ইসলাম আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে তারাগঞ্জ কগনিজেন্স আদালতের বিচারক কৃষ্ণ কমল রায় ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
উৎসুক জনতার পা ধরে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন রূপলাল: ‘বাবা হামাক মারেন না বাহে..., হামরা চোর না। কাল মোর মেয়ের আশীর্বাদ। মোক মারি ফেলাইলে মোর বউ-বাচ্চাও মরি যাইবে। এভাবেই মব সৃষ্টিকারী শত শত উৎসুক জনতার পা ধরে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন তারাগঞ্জের কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মুচি সম্প্রদায়ের রূপলাল।’ এ সময় বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন ভাগ্নিজামাই প্রদীপও। কিন্তু শত শত উৎসুক মানুষ তাদেরকে চোর ট্যাগ দিয়ে শুরু করে গণধোলাই। জীবন ভিক্ষা চেয়েও বাঁচেননি রূপলাল ও প্রদীপ। শুধু তাই নয়, এমন ঘটনা চোখে দেখেও নীরব ভূমিকা পালন করে পুলিশ। যা নিয়ে হয় কঠোর সমালোচনা। থানা থেকে মাত্র সাড়ে ৭ কিলোমিটার দূরত্বে ঘটনাস্থল হলেও পুলিশ গণপিটুনির শিকার রূপলাল ও প্রদীপকে রক্ষা করতে পারেনি। সাফাইয়ে পুলিশ বলেছে, মব সৃষ্টিকারী প্রায় ৪ হাজার, আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাত্র চার পুলিশ। মাত্র চার পুলিশের পক্ষে রূপলাল ও প্রদীপকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
যা বলছেন রূপলালের প্রতিবেশীরা: তারাগঞ্জের কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা প্রসন্ন লাল বলেন, একজন মানুষ যদি চোরও হয়ে থাকে, তবুও তাকে মেরে ফেলার অধিকার কারও নেই। তারা পুলিশে দিয়ে দিতো। এভাবে কি মানুষ মারতে পারে। তুষার বলেন, ভিডিওতে দেখেছি দু’জন মানুষকে আঘাত করতে করতে মেরে ফেলার পরও উৎসুক জনতা আঘাত করা থামায়নি। ধিক্কার জানাই এমন মানুষদের। দীজেন লাল বলেন, রূপলাল কাকা পা ধরে জীবন ভিক্ষা চাইছে। সামনে মেয়ের বিয়ে, অনেক কাজ আছে মাফ করি দাও বাবা বলে আর্তনাদ জানিয়েছে, তবুও তাদের মন গলেনি। দেশটা মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে। যার যা ইচ্ছা করছে তাই করছে। এ ঘটনায় জড়িত সকলকে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে।
এ বিষয়ে কোর্ট পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম বলেন, গোপন তথ্য ও সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও মব সৃষ্টি করে যারা দেশ, জনগণ ও আইন-শৃঙ্খলাকে হুমকির মুখে ফেলার চেষ্টা করবে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। জেলা পুলিশ সুপার আবু সায়েম বলেন, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্যরা ঘটনার দিন মোবাইল টিমের দায়িত্বে ছিলেন। সেই সঙ্গে রূপলাল হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আবু জোবায়েরকে তদন্ত কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে তারাগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রফিকুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৯ই আগস্ট রাতে তারাগঞ্জের কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের রূপলাল ও তার ভাগ্নি জামাই প্রদীপ সৈয়দপুর থেকে বাংলা মদ নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। রাত সাড়ে ৯টায় তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাটে এলে তাদের ভ্যান থামিয়ে কিছু যুবক মদের ব্যাগ কেড়ে নেয় এবং চোর চোর বলে চিৎকার করে। এ সময় স্থানীয়দের গণপিটুনিতে রূপলালের মৃত্যু হয়। পরে ১০ই আগস্ট রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহত প্রদীপ মারা যান।