
গতবছরের ১৭ জুলাই আন্দোলনের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হলগুলো থেকে বের করে দেওয়া হয় আন্দোলনে হামলাকারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সেদিন থেকেই হলে হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল প্রশাসন। এ ঘটনার পর আর কোনও ছাত্র সংগঠন হলে তাদের কমিটি না দেওয়ায় এ নিয়ে ছিল না কোনও আলাপ-আলোচনা। তবে সেখানে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কমিটি থাকবে কি না বা রাজনীতির সংস্কার প্রসঙ্গে প্রশাসনের সঙ্গে সবসময়ই আলোচনায় বসেছে ছাত্র সংগঠনগুলো।
তবে গত শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ১৮টি হলে ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় উত্তেজনা। এদিন মধ্যরাতে হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। হল থেকে রাস্তায় নেমে আসেন নারী শিক্ষার্থীরা। এসময় বিভিন্ন হল থেকে ছোট মিছিল নিয়ে এসে টিএসসিতে একত্রিত হয় ছেলে শিক্ষার্থীরাও। পরবর্তীতে তারা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীদের তীব্র বিক্ষোভের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের উপস্থিতিতে এ ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ। ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ২০২৪ সালের ৭ জুলাইয়ের ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।
তবে ১৭ জুলাইয়ের 'ফ্রেমওয়ার্ক' কী, তা স্পষ্ট করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আবাসিক হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের চলমান দাবির বিষয়ে আলোচনা করতে শনিবার বেলা ১২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি। তবে বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে এখনও জানায়নি প্রশাসন।
এ ঘোষণার পর, অনেকের কাছে প্রশ্ন উঠেছে- উপাচার্য কি চাইলে এককভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? উনি যদি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন তাহলে সিন্ডিকেটের কাজ কি অথবা সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে কিনা।
এ প্রশ্নের উত্তরে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ বলেন, আমরা সারাদিন এটা নিয়ে মিটিং করেছি, প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিংও ছিল। আরও আলোচনা করা হবে তারপর ফাইনাল সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।
তবে কোনও সিন্ডিকেট মিটিং ছাড়া উপাচার্য হলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকবে, এ ধরণের কোনও ঘোষণা দিতে পারেন কিনা সে ব্যাপারে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ধারা ১২(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি কোনও জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয় যে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া আবশ্যক, তাহলে উপাচার্য এককভাবে কোনও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। তবে, ৭ দিনের মধ্যে সেই কার্যক্রমের প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে (যে কর্তৃপক্ষ সাধারণত বিষয়টি দেখবে) জমা দিতে হবে।
এছাড়াও অধ্যাদেশের ধারা ১২(৪) অনুযায়ী, যদি উপাচার্য কোনও সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হন, তাহলে তিনি সেটি বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকতে পারেন এবং সিন্ডিকেট বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরবর্তী নিয়মিত সভায় পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন। এখানে পুনর্বিবেচনার পরেও যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মত উপাচার্যের মতের বিপরীতে হয়, তাহলে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
যা বলছে ছাত্রসংগঠনগুলো
এ বিষয়ে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, উপাচার্য চাইলেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলে অবশ্যই সেটা সিন্ডিকেট থেকে পাস হয়ে আসতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে উনি যেকোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিন্তু সেটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করে নয়। আমার মনে হয় বিক্ষোভকে শিথিল করতেই উনি রাজনীতি বন্ধের কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, অনেকেই ভাবছেন আমরা ছাত্রলীগের মতো দখলদারত্বের রাজনীতি করবো। কিন্তু আমরা সেটি হতে দেবো না কারণ আমরাই সবচেয়ে বেশি ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার। আমাদের দ্বারা তো নয়ই ছাত্রলীগের সংস্কৃতিকে আমরা আর ফিরতেই দেবো না।
ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাঈন ইসলাম বলেন, জনপরিসরে সংগঠন করার কিংবা সংগঠিত হওয়ার অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত। ৭৩-এর অধ্যাদেশেও এই স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সংগঠন করা কিংবা না করা ব্যক্তি নাগরিকের ইচ্ছাধীন। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও হলে শিক্ষার্থীরা হলকেন্দ্রীক কাঠামো নির্মাণের পূর্ণ অধিকার রাখেন।
তিনি বলেন, সমস্যাটা বাধে যখন কাউকে জোর করে সাংগঠনিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় কিংবা সাংগঠনিক কাঠামো ব্যবহার করে গেস্টরুম নির্যাতনের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হয়। তার মানে আপনার এই সমস্যাগুলোর প্রতিকার খুঁজে বের করতে হবে। জবরদস্তি, সন্ত্রাস এসব প্রতিরোধের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তা না করে সংগঠন করার নাগরিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া কোনও সমাধানের মধ্যে পড়ে না এবং এই অধিকার কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তো কোনোভাবেই নেই।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাবি সংসদের আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, রাজনীতির নামে হল দখল, সিট দখল, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার থাকতে হবে। এর কোনও বিকল্প নেই। জোর করে মিছিল-মিটিংয়ে নিয়ে যাওয়াটা যেমন অন্যায়, কাউকে জোর করে রাজনীতি করতে না দেওয়াটাও একইরকম অপরাধ।
তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসের যেকোনও পর্যায়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশ, ১৯৭৩ -এর বিরোধী। এটা সংবিধানের ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ নং অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধাচারণও বটে। হল/ক্যাম্পাসে সংগঠন করার অধিকার সংকোচিত করার সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ গণমাধ্যমকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় এর আগেও মৌখিকভাবে অনেক ঘোষণা দিয়েছে। মৌখিক ঘোষণার ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখন উচিত অংশীজনদের সঙ্গে বসে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি লিখিত নীতিমালা তৈরি করা। যার মাধ্যমে যে রাজনীতি করতে চাইবে না, তার অধিকার যেমন হরণ হবে না, একইভাবে যে রাজনীতি করতে চাইবে, তারও যাতে অধিকার হরণ না হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'সংজ্ঞায়নবিহীন কোনও ঘোষণার পক্ষ নেওয়া বা বিরোধিতা করার সুযোগ থাকে না। কী নিষেধ করছেন, কতটুকও এরিয়ার মধ্যে করছেন, এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উল্লেখ করেনি। নিষেধাজ্ঞা মানলে কী হবে, না মানলে কী হবে, এসব কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করা কঠিন।'