
- সুমন মাহমুদ
সাম্প্রতিককালে মরক্কোতে দীর্ঘ সফর শেষে লন্ডনে ফিরে আমি সেখানকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তৃত অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ পাই। প্রায় সাড়ে চার হাজার মাইল ভ্রমণের মধ্য দিয়ে দেশটির নানান প্রান্তে গিয়ে আমি বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় করি। এই যাত্রা আমাকে নানা অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত করেছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা টেনে এখানে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি।
আরব বসন্তের সময় ও পরবর্তীতে মরক্কোর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (পিজেডি) বহু পর্যবেক্ষকের কাছে রাজনৈতিক ইসলামের একটি সফল ‘মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। অন্যান্য আরব দেশের ইসলামপন্থী দলগুলো যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে পিজেডি দীর্ঘদিন রাজতন্ত্রের সঙ্গে কৌশলগত আপোশের মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকে দেখিয়েছিল—রাজতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরেও সীমিত রাজনৈতিক স্পেস অর্জন সম্ভব।
তবে ২০২১ সালের নির্বাচনে পিজেডির বিপুল পরাজয় এই ‘মডেল’-এর স্থায়িত্ব নিয়ে বড় প্রশ্ন তোলে। এক দশক ক্ষমতায় থাকার পরও দলের জনসমর্থন তীব্রভাবে হ্রাস পায় এবং তারা ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়, মরক্কোর রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসলামপন্থী দলগুলোর প্রভাব রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণসীমা অতিক্রম করতে পারেনি। আপোশের বিনিময়ে রাজনৈতিক টিকে থাকার সুযোগ তারা পেলেও, আদর্শ থেকে সরে আসা এবং জনমতের সঙ্গে দূরত্ব—দলটির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবকে সীমিত করে রেখেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আরও জটিল। জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামি দলগুলোর দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এদের মধ্যে ঐক্যের প্রচেষ্টা দেখা গেলেও, বড় প্রশ্ন থেকে যায়—এই দলগুলোর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কতটা সাধারণ জনগণের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? বাংলাদেশের ভোটাররা এখন অনেক বেশি বাস্তববাদী; তারা এমন কোনো শক্তিকে সমর্থন দিতে অনিচ্ছুক, যারা দেশের সার্বিক উন্নয়ন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সংবিধানসম্মত ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধে বাধা দেয়।
বর্তমানে জামায়াতের ভোটের হার প্রায় ১১ শতাংশেরও কম—যা প্রমাণ করে, ইসলামপন্থী দলগুলোর নির্বাচনী সাফল্যের সম্ভাবনা সীমিত। মরক্কোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার মূল বার্তা হলো—শুধু নির্বাচনে জয়লাভই যথেষ্ট নয়; বরং জনসমর্থন ধরে রাখা এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইসলামের জন্য পথ আরও কঠিন—কারণ এখানে বহুমাত্রিক রাজনৈতিক শক্তি, সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা, শক্তিশালী নাগরিক সমাজ এবং সক্রিয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। ক্ষমতায় যাওয়ার পর ইসলামি দলগুলোর জন্য প্রশ্ন থাকবে—তারা কি দেশের প্রশাসনিক কাঠামো, সামরিক ও বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনী, বেসরকারি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করে কার্যকর শাসন পরিচালনা করতে পারবে? অতীত অভিজ্ঞতা বলে—তাদের আদর্শগত অবস্থান কখনও কখনও এই কাঠামোর সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে, যা শাসন ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করবে।
মরক্কোর অভিজ্ঞতা স্পষ্ট করেছে—রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন মানেই শক্ত ভিত্তি নয়; বরং স্বৈরতান্ত্রিক বা আধা-গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচনে জয়ী হলেও, আদর্শগত আপোশ ও জনমতের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা দলের পতন ডেকে আনতে পারে।
তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের জন্য মরক্কোর ‘মডেল’-এর পতন এক ধরনের সতর্কবার্তা। ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি দেশের গণতন্ত্র, সংবিধান, সামাজিক সম্প্রীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে না পারলে ঐক্য বা জনপ্রিয়তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। জনমতের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এবং বাস্তবতার সঙ্গে আপোসের সঠিক ভারসাম্য গড়ে তোলাই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
- লেখক, গবেষক ও টিভি উপস্থাপক।